নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধীদের মধ্যে হাতাহাতি কিংবা অবরুদ্ধ করার ঘটনা কেন

আন্দোলনের পরে দল গঠনের চিন্তা থেকেই তৈরি হয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি।
ছবির ক্যাপশান, আন্দোলনের পরে দল গঠনের চিন্তা থেকেই তৈরি হয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে তাদেরই সমমনা জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছু বিরোধের ঘটনা নিয়ে আলোচনা চলছে।

সম্প্রতি পিরোজপুরে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ হাতাহাতি পর্যন্ত গড়িয়েছে। আবার চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদসহ কয়েকজনকে অবরুদ্ধ করার ঘটনা ঘটেছে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে।

এসব ঘটনার কারণে উভয় সংগঠনের মধ্যে কোনো দূরত্ব তৈরি হয়েছে কি না কিংবা কোনো দূরত্বের কারণে এসব ঘটনা ঘটছে কি না, তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে।

তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলছেন দুটি ঘটনাই তাদের নজরে এসেছে এবং তারা সাংগঠনিকভাবে তদন্ত করছেন।

"তবে এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমরা দেখছি কারা অপরাধী আর কারা নিরপরাধী। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবো। এটি জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যকার কোনো সমস্যা নয়," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. সোহেল।

জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রথম যুগ্ম আহবায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বলছেন চট্টগ্রামের ঘটনায় নাগরিক কমিটির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, তবে পিরোজপুরের ঘটনা শুনে তারা সেটিকে স্থানীয়ভাবে মিটমাটের পরামর্শ দিয়েছেন।

এছাড়া ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একজন নেতাকে হেনস্থার খবর পাওয়া গেলেও তার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনা সরকারের শেষ দিকে সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সাংগঠনিক রূপ নিয়েছিলো। আন্দোলন দানা বাঁধার সময় অনেকেই সমন্বয়ক হিসেবে এক সাথে কাজ করেছিলেন, যাদের অনেকেই এখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটিতে নেই।

বিবিসি বাংলায় আরও পড়ুন:
বিজয় দিবসে নাগরিক কমিটির র‍্যালী
ছবির ক্যাপশান, বিজয় দিবসে নাগরিক কমিটির র‍্যালি

দুই সংগঠনের মধ্যকার সম্পর্ক

সংগঠনটির ভাষায় 'গণঅভ্যুত্থানের শক্তিকে সংহত করে দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্য নিয়ে' গত ৮ই সেপ্টেম্বর জাতীয় নাগরিক কমিটি যাত্রা শুরু করলেও এই সংগঠনের অনেকেই মূলত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে আসা।

অন্যদিকে, নাগরিক কমিটিতে মূলত সাংগঠনিক নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের সাথে ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলনে জড়িত ছিলেন এমন কয়েকজন। এর মধ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত।

যদিও পরে গত ৯ই ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সারজিস আলম জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক মনোনীত হন।

তখন নাগরিক কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়েছিলো, "ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাস্তবায়নের কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য সারজিস আলমকে মুখ্য সংগঠক পদে মনোনীত করা হলো।"

জানা গেছে এখন পর্যন্ত দেড়শর বেশি থানা ও উপজেলায় নিজেদের কমিটি করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও জেলা ও বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন করছে।

জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা ইতোমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন।

ধারণা করা হচ্ছে নতুন দল হলে সেখানে নাগরিক কমিটির সাথে যোগ দিবেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা নেতারা। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরিচালিত হবে শুধু শিক্ষার্থীদের দ্বারাই।

মূলত এ লক্ষ্যেই উভয় সংগঠন দেশজুড়ে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে বৈষম্যবিরোধীরা এখন বিভিন্ন জায়গায় 'জুলাই ঘোষণাপত্র' নিয়ে গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করছে। ফলে কোনো কোনো জায়গায় এসব কর্মসূচির নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে সংগঠন দুটির নেতাদের মধ্যে মতবিরোধের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে ৩১শে ডিসেম্বর শহীদ মিনারে 'জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র' প্রকাশের দিয়ে প্রত্যাহার করা হয়েছিলো
ছবির ক্যাপশান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে ৩১শে ডিসেম্বর শহীদ মিনারে 'জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র' প্রকাশের দিয়ে প্রত্যাহার করা হয়েছিলো

পিরোজপুরে কী হয়েছে

মূলত 'জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র' নিয়ে লিফলেট বিতরণকে কেন্দ্র করে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে রবিবার দুপুরে।

পিরোজপুর টাউন ক্লাব মাঠে দুই পক্ষের লিফলেট বিতরণ শেষে হাতাহাতির এ ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। এক পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা পিরোজপুরের জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতা-কর্মীদের বয়কটের ঘোষণা দেন।

জানা গেছে সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে দুই ভাগ হয়ে গেছে। এক অংশ নাগরিক কমিটি ও অন্য অংশ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নাম নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

রবিবার লিফলেট বিতরণ শেষে টাউন হল ক্লাব মাঠে সমবেত হয়ে তারা আলোচনা সভা শুরু করেন। এর মধ্যেই কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আরিফুল ইসলাম আদিব বলছেন, দুটি সংগঠন কাজ করছে কিন্তু তারা কোনোপক্ষই কারও কাজে হস্তক্ষেপ করেন না।

"আমরা পিরোজপুরে উভয় পক্ষকে পরামর্শ দিয়েছি তারা যেন নিজেদের মধ্যে ঝামেলা মিটিয়ে নেয়। এ নিয়ে আপাতত আর কোনো সমস্যা নেই," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. আদিব।

পিরোজপুরে লিফলেট বিতরণকে কেন্দ্র করে বিরোধে জড়ায় জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

ছবির উৎস, TV SCREEN GRAB

ছবির ক্যাপশান, পিরোজপুরে লিফলেট বিতরণকে কেন্দ্র করে বিরোধে জড়ায় জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

চট্টগ্রামে কী হয়েছিল

শনিবার চট্টগ্রামে ওয়াসা এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ ও কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদসহ কয়েকজনকে অবরুদ্ধ করে হামলার অভিযোগ উঠেছে।

মি. মাসউদসহ কয়েকজন 'জুলাই ঘোষণাপত্রের' পক্ষে পথসভার পর লিফলেট বিতরণের পাশাপাশি জনসংযোগ করছিলো। সেখানেই তাদের অবরুদ্ধ করে হামলার ঘটনা ঘটেছে।

সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একজন নেতাও মি. মাসউদের সাথে দুর্ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ ঘটনার প্রতিবাদে রোববার চট্টগ্রামের প্রেসক্লাব চত্বরে 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রাম'-এর ব্যানারে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এতে দাবি করা হয় যে মি. মাসউদকে অবরুদ্ধ ও হামলার ঘটনায় সাত জন আহত হয়েছে।

সংগঠনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলছেন সংগঠন থেকে তারা পুরো ঘটনা খতিয়ে দেখছেন।

"ঘটনাটি কেন ঘটেছে তা আমরা দেখছি। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে পারে। আমরাও দেখবো কে অপরাধ করেছে। কারও মধ্যে কোনো অসন্তোষ থাকলে সেটিও দেখা হবে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

তবে তিনি নাগরিক কমিটির সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যকার কোনোরকম দূরত্বের খবর উড়িয়ে দিয়েছেন।

ঘোষণাপত্রের সমর্থনে সাত দফা দাবি সম্বলিত লিফলেট উভয় সংগঠনের
ছবির ক্যাপশান, ঘোষণাপত্রের সমর্থনে সাত দফা দাবি সম্বলিত লিফলেট উভয় সংগঠনের

দল গঠন কতদূর

বাংলাদেশে গত অগাস্ট থেকেই ছাত্রদের নেতৃত্বে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হচ্ছে– এমন একটা আলোচনা ব্যাপকতা পেলেও এখনো তা সাংগঠনিক রূপ লাভ করেনি।

অভ্যুত্থানের এক মাস পর সেপ্টেম্বরে আন্দোলনের নেতাদের নিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথা বলে আত্মপ্রকাশ করেছিলো জাতীয় নাগরিক কমিটি।

গেল প্রায় চার মাস ধরে সারাদেশে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কমিটি গঠন করে সংগঠনের বিস্তৃতিও ঘটিয়েছেন তারা।

নাগরিক কমিটির নেতারা আশাবাদী তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত একটি বড় রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের ব্যাপারে যেখানে মূল ভূমিকায় থাকবে তারা। পাশাপাশি সেই দলে ভূমিকা থাকবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরও।

কমিটির নেতারা জানিয়েছেন দল গোছানোর প্রক্রিয়া চলমান আছে এবং আগামী মাস নাগাদ কমিটি গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আশা করছেন তারা।

"বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দীর্ঘসময় ধরে ক্ষমতায় ছিল। তাদেরকে মানুষ দেখেছে। কিন্তু এর বাইরে গিয়ে জনগণের একটা বিশাল অংশ আছে, যারা নতুন একটি রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব দেখতে চায়। সে জায়গা থেকে আমরা মনে করি আমাদের দল গঠিত হলে সেটা জনসমর্থন পাবে," বিবিসি বাংলাকে সম্প্রতি বলেছেন নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন।