মদনমোহন মন্দির
মদনমোহন মন্দির | |
---|---|
ধর্ম | |
অন্তর্ভুক্তি | হিন্দুধর্ম |
জেলা | বাঁকুড়া |
ঈশ্বর | কেষ্ট রায় (কৃষ্ণ) |
অবস্থান | |
অবস্থান | বিষ্ণুপুর |
রাজ্য | পশ্চিমবঙ্গ |
দেশ | ভারত |
স্থানাঙ্ক | ২৩°৪′৫০.৫০৭৪৭″ উত্তর ৮৭°১৯′২৪.৯৪৯৯৯″ পূর্ব / ২৩.০৮০৬৯৬৫১৯৪° উত্তর ৮৭.৩২৩৫৯৭২১৯৪° পূর্ব |
স্থাপত্য | |
ধরন | বাংলার মন্দির স্থাপত্য |
স্থাপত্য শৈলী | একরত্ন |
প্রতিষ্ঠাতা | দুর্জন সিংহ দেব |
প্রতিষ্ঠার তারিখ | ১৬৯৪ |
বিনির্দেশ | |
সম্মুখভাগের দিক | দক্ষিণ |
দৈর্ঘ্য | ১২.২ মিটার (৪০ ফু) |
প্রস্থ | ১২.২ মিটার (৪০ ফু) |
উচ্চতা (সর্বোচ্চ) | ১০.৭ মিটার (৩৫ ফু) |
[১] |
মদনমোহন মন্দির হল মেদিনীপুর বিভাগের বিষ্ণুপুর শহরের একটি কৃষ্ণ মন্দির। অতীতে, এই মন্দিরে হিন্দু দেবতা কৃষ্ণকে মদনমোহন রূপে পূজার্চনা করা হলেও বর্তমানে কোনো পূজা করা হয় না। মন্দিরে প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠা ফলক অনুযায়ী, মন্দিরটি ১৬৯৪ খ্রীস্টাব্দে (১০০০ মল্লাব্দ) মল্লভূমের রাজা দুর্জন সিংহ দেব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মন্দিরটি একরত্ন মন্দিরের স্থাপত্যের একটি অনন্য উদাহরণ, যা মধ্যযুগীয় বাংলায় বিকশিত রত্ন শৈলীর অন্তর্গত।[২]
এই মন্দিরটির ছাদ চৌকো ও বাঁকানো, কিনারা বাঁকযুক্ত ও মধ্যে গম্বুজাকৃতি শীর্ষ বর্তমান। মন্দিরটি অলংকরণের জন্য অনেক বেশি পরিচিত, যা এই মন্দিরের দেয়ালগুলিকে অলঙ্কৃত করে। অলঙ্করণগুলি প্রধানত দেয়ালে স্থাপিত পোড়ামাটির ফলকের উপর স্থাপিত হয়েছে। মন্দিরের দেওয়ালে কৃষ্ণলীলা, দশাবতার ও অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনীর বিভিন্ন দৃশ্য ভাস্কর্যের মাধ্যমে রূপায়িত। মন্দিরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১২.২ মিটার এবং উচ্চতা ১০.৭ মিটার।[৩]
বর্তমানে মন্দিরটি এটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ দ্বারা অন্যতম একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসাবে সংরক্ষিত রয়েছে।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]মল্লাধিপতি বীর হাম্বীর মল্লদেব মদনমোহন বিগ্রহ বিষ্ণুপুরে প্রতিষ্ঠা করেন।বিষ্ণুপুরের ৫৫ তম রাজা শ্রী গোপাল সিংহ ছিলেন মদনমোহনের একনিষ্ঠ ভক্ত। এসময় মারাাঠা দস্যুরা ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে এক লক্ষ সেনা নিয়ে বিষ্ণুপুর আক্রমণ চেষ্টা করলে রাজা সমরসজ্জায় দৃষ্টি না দিয়ে প্রজাদের মদনমোহনের উপাসনা করার নির্দেশ দেন। কথিত আছে মদনমোহন নিজহস্তে কামানের তোপ বর্ষণ করে বিষ্ণুপুর কে রক্ষা করেন। যদিও ঐতিহাসিকেরা এই কিংবদন্তির সাথে সহমত নন তাদের মতে বিষ্ণুপুরের দুর্গ সেসময় অত্যন্ত দৃঢ় ছিল যা ভেদ করা মারাঠা দস্যু দের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
বিষ্ণুপুরের ৫৬তম রাজা চৈতন্যদেবের আমলে ব্রিটিশের চক্রান্তে বিশাল রাজস্ব দেনায় রাজা অষ্টধাতুর মদনমোহন বিগ্রহ বন্ধক রাখেন। এভাবে মদনমোহন বিগ্রহ হাতছাড়া হয়। বর্তমানে বাগবাজার মদনমোহন মন্দিরে এই মূর্তি অধিষ্ঠান রত।
স্থাপত্য
[সম্পাদনা]মদনমোহন মন্দির বাংলার মন্দির স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত হয়েছে। মন্দিরটি একটি প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত আয়তকার প্রাঙ্গণ নিয়ে গঠিত; প্রাঙ্গণে মুখ্য দেবালয়, ভোগমণ্ডপ ও নাটমন্দির রয়েছে। মুখ্য দেবালয়ে বাংলার বিখ্যাত রত্ন শৈলী দেখা যায়; এটি একরত্ন শৈলীতে নির্মিত। মন্দিরের কাঠামোটি বাঁকানো ছাদ সহ ঘর ও একটি রত্ন সহযোগে গঠিত। মন্দিরটি তার বাঁকা কার্নিশ প্রাথমিক চালা শৈলীর উপাদানগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা এই সময়ের মধ্যে নির্মিত বাংলার হিন্দু মন্দিরগুলিতে সাধারণ ছিল। ভোগমণ্ডপ ও নাটমন্দির চালা শৈলীতে নির্মিত হয়েছে, এবং পশ্চিম দিকের প্রাচীর সঙ্গে চালা শৈলীতে নির্মিত একটি তোরণ রয়েছে। মন্দিরটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ দ্বারা সুন্দরভাবে সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত করা হয়েছে।
মুখ্য দেবালয়
[সম্পাদনা]মন্দিরটি পাথর নির্মিত একটি মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে আছে, যার দৈর্ঘ ও প্রস্থ উভয়ই ১২.২ মিটার (৪০ ফু)। মন্দিরের মেঝের পরিমাপ হল ১৪৮.৮৪ মিটার (১৬০০ বর্গফুট) এবং দক্ষিণ দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ১.৪ মিটার (৪ ফু ৭ ইঞ্চি) উচ্চতার মাকড়া-পাথরের ভিত্তিবেদীর ওপর স্থাপিত মন্দিরের উচ্চতা ১০.৭ মিটার (৩৫ ফু)।
সম্মুখভাগ
[সম্পাদনা]মন্দিরের দ্বারপথটি দক্ষিণমুখী; দ্বারপথ তিনটি খিলান নিয়ে গঠিত। তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথের উপরে, জ্যামিতিক নকশার একটি বিস্তৃত দল একটি এলাকাকে চিত্রিত করে, যা কেন্দ্রীয় দৃশ্য হিসাবে প্রদর্শিত হয়। কাঠামোটি ছাদের বাঁকানো কার্নিশকে প্রতিধ্বনিও করে। সমরনায়ক ব্যক্তিগণ ধনুক ও তীর নিয়ে একে অপরের মুখোমুখি যুদ্ধের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। যোদ্ধাদের এই ভিড়ের মধ্যে একটি অনুভূমিক চিত্রে দেখানো হয়েছে – তীর শয্যায় মৃত্যুবরণ করছেন ভীষ্ম, যা যুদ্ধকে মহাভারতের চূড়ান্ত যুদ্ধ হিসাবে চিহ্নিত কররে। দক্ষিণ প্রবেশদ্বার সমর্থনকারী স্তম্ভগুলি তিনটি খণ্ডে বিভক্ত, পদ্ম কুঁড়ি ঝালর দিয়ে প্রক্ষেপণ ছাঁচনির্মাণ দ্বারা পৃথক করা হয়েছে। নর্তকী এবং ঢোল বাদকগণ সহ ফলকসমূহ স্তম্ভের প্রস্থের সঙ্গে মানানসই ভাবে স্থাপন করা হয়েছে।[৪]
রত্ন
[সম্পাদনা]মুখ্য দেবালয়ের ছাদের উপরে একটি মাত্র রত্ন বা শিখর রয়েছে, যা একরত্ন মন্দির স্থাপনার মুখ্য বৈশিষ্ট। শিখরে রথ ও গম্বুজ স্থাপত্য পরিলক্ষিত হয়, যা স্থাপত্য শৈলী দুটিকে সংমিশ্রিত করেছে। শিখরে তিনটি অংশ রয়েছে — রথ, গম্বুজ এবং আমলক ও কলস। গম্বুজের নীচের অংশটি রথ স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত, এবং এই শিখরে নবরথ বৈশিষ্ট রয়েছে। শিখরের প্রতি পার্শ্বে একটি করে খিলান রয়েছে। শিখরের চার দেয়ালের উপরে একটি গম্বুজ নির্মিত হয়েছে। গম্বুজের উপরে আমলক ও কলস অংশটি অবস্থিত। কলসের উপরে একটি চক্র স্থাপিত রয়েছে।
নাটমন্দির
[সম্পাদনা]নাটমন্দিরটি চালা শৈলীতে নির্মিত হয়েছে; মন্দিরের ছাদ চারটি চালা নিয়ে গঠিত, যা চালা শৈলীর চারচালা প্রকারকে নির্দেশ করে। এটি আয়তকার ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে আছে, এবং উত্তরমুখী; সম্মুখভাগে দুটি স্তম্ভ সমর্থিত তিনটি খিলান রয়েছে, যা প্রবেশ ও প্রস্থানের পথ। খিলান-কাঠামোর প্রতিটি খিলানের উপরে দুটি করে পদ্ম ফুলের মোটিফ রয়েছে। এই খিলান কাঠামোর প্রতি পাশে দেওয়ালের সঙ্গে একটি করে অতিরিক্ত খিলান রয়েছে। নাটমন্দিরের অন্য তিনটি দেয়ালে কোন খিলান বা দরজা নেই। নাটমন্দিরের দুটি দেয়াল মিলিত হয়ে যে কোণ গঠন করে, তা অন্যান্য চালা বা রত্ন শৈলীর মন্দিরের মতই নির্দিষ্ট ব্যবধানে রৈখিক অনুভূমিক অভিক্ষেপ প্রদর্শন করে।
প্রাঙ্গণের দক্ষিণ প্রান্তে প্রাচীরের সঙ্গে সন্নিবিষ্টভাবে নির্মিত। এটি মন্দিরের দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত ভোগ রানান রান্না ও প্রস্তুতের জন্য ব্যবহৃত হত।
ভোগমণ্ডপ
[সম্পাদনা]ভোগমণ্ডপটি চালা শৈলীতে নির্মিত হয়েছে; মন্দিরের ছাদ চারটি চালা নিয়ে গঠিত, যা চালা শৈলীর চারচালা প্রকারকে নির্দেশ করে। এটি আয়তকার ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে আছে, এবং পশ্চিমমুখী; সম্মুখভাগে দুটি স্তম্ভ সমর্থিত তিনটি খিলান রয়েছে, যা প্রবেশ ও প্রস্থানের পথ। খিলানাকার কাঠামোতে কোন প্রকার অলংকরণ বা মোটিফ নেই। প্রাঙ্গণের উত্তর পূর্ব অংশে পূর্ব প্রাচীরের সঙ্গে সন্নিবিষ্টভাবে নির্মিত। এটি একটি তীর্থযাত্রীদের বিশ্রামের স্থান ও অনুষ্ঠানের আচার সময় অপেক্ষা করার জন্য ব্যবহৃত হত।
তোরণ
[সম্পাদনা]মন্দিরে মুখ্য প্রবেশদ্বার বা তোরণটি পশ্চিম দিকের প্রাচীরে হয়েছে। এটি দু’টি চালা সহ চালা শৈলীতে নির্মিত, যা দোচালা বা একবাংলা শৈলীকে নির্দেশ করে। তোরণের ছাদ বা চালাটি খিলানাকার কাঠামোর সমর্থনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি ঢালু চালা নিন্ম অংশের প্রান্তভাগের সঙ্গে খিলানার কাঠামো সংযুক্ত রয়েছে; এই কাঠামো তিনটি খিলানা দ্বারা গঠিত। তোরণের দুই পার্শ্বে মন্দির প্রাঙ্গণের প্রাচীর সংযুক্ত রয়েছে।
মন্দির প্রাঙ্গণের প্রবেশ মুখ অবস্থিত খিলান ও প্রাঙ্গণ থেকে প্রস্থান পথের স্মুখে অবস্থিত খিলানাকার কাঠামোর মাঝের খিলানটি প্রবেশ ও প্রস্থান পথ হিসাবে ব্যবহৃত হয়, মাঝের খিলানের দুই পাশে অবস্থিত খিলান শুধুমাত্র কাঠামকে সমর্থন প্রধান করে। মাঝের খিলানের মধ্যদিয়ে যে প্রবেশ পথ মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেছে, সেই প্রবেশ পথের দুই পাশে তোরণের মধ্যে উচু বেদি বা মেঝে রয়েছে।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৭১, পৃ. ৮৬।
- ↑ "Bankura : Tourism"। web.archive.org। ২০১৬-০১-০৮। Archived from the original on ২০১৬-০১-০৮। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-০৬।
- ↑ "'গুগ্ল' ম্যাপে এ বার বিষ্ণুপুরের মন্দির"।
- ↑ Ghosh 2005, পৃ. 145।
গ্রন্থপঞ্জি
[সম্পাদনা]- বিশ্বাস, এস. এস. (১৯৯২)। "The Temples"। Bishnupur (ইংরেজি ভাষায়) (দ্বিতীয় সংস্করণ)। নতুন দিল্লি: ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ। সংগ্রহের তারিখ ১১ মার্চ ২০২৪।
- Ghosh, Pika (২০০৫)। Temple to Love: Architecture and Devotion in Seventeenth-Century Bengal (ইংরেজি ভাষায়)। Bloomington and Indianapolis: Indiana University Press।
- বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিয়কুমার (১৯৭১)। বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি। কলকাতা: পূর্ত দপ্তর, পশ্চিমবঙ্গ।