অপরাহ্ন
অপরাহ্ন হল সৌর দুপুরের পরের সময়। স্থানভেদে দুপুরের সংজ্ঞা ভিন্নরকম। ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশে সাধারণত দিনের বেলা ১২:০০ টা থেকে সন্ধ্যার পূর্ব পর্যন্ত সময়কে দুপুর বলা হয়। সূর্য মধ্য আকাশ থেকে পশ্চিমে যাওয়া শুরু করা থেকে সন্ধ্যে বেলা পশ্চিম আকাশে অস্ত যাওয়া পর্যন্ত সময়কে এসব অঞ্চলে দুপুর বলে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে বেলা ১২:০০ টা থেকে বিকাল পর্যন্ত সময়কে এশিয়ার কিছু অঞ্চলে ও ভারতীয় উপমহাদেশে দুপুর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মানুষের কর্মজীবনে দিনের পরবর্তী প্রায় অর্ধেক সময়ই দুপুর বেলার অন্তর্গত। দুপুর বেলার সময় মানুষের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা ইত্যাদি বিষয়ের সাথে জড়িত। দুপুরের প্রথম ভাগে অধিকাংশ মানুষ দুপুরের খাবার গ্রহণ করে থাকে এবং দুপুরের সময় থেকে মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে শুরু করে। এছাড়া এসময় অধিক গাড়ি দুর্ঘটনাও ঘটে। পৃথিবীর দুপুর বেলার পরিমাণ সময় থেকে অন্যান্য গ্রহের দুপুরের পরিমাণ থেকে ভিন্ন।
পরিভাষা
[সম্পাদনা]ইউরোপ (বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপ) ও আমেরিকা মহাদেশে দুপুর হল দুপুরের মধ্যভাগ থেকে সন্ধ্যার পূর্ব পর্যন্ত সময়।[১] দুপুরের মধ্যভাগ বলতে বেলা ১২:০০ টা বোঝানো হয়।[২] কিন্তু দুপুর কখন শেষ হবে তা নির্ভর করে সন্ধ্যা যখন শুরু হয় তার উপর। যেহেতু স্থানভেদে সন্ধ্যা হওয়ার সময়ে তারতম্য থাকে তাই, দুপুর বেলার সময়ের পরিমাণও স্থানভেদে ভিন্ন। ভারতীয় উপমহাদেশে দিনের বেলা ১২:০০ টা থেকে বিকালের পূর্ব পর্যন্ত সময়কে দুপুর বলে। বিকাল বলতে দুপুরের শেষভাগ এবং সন্ধ্যার মাঝের অংশকে বুঝায়। দ্বাদশ থেকে চৌদ্দশ শতক পর্যন্ত সময়ে দুপুরের মধ্যভাগ বলতে বেলা ৩:০০ বোঝানো হত। এর কারণ সম্ভবত ছিল উপাসনা বা দুপুরের খাওয়ার সময়। সুতরাং সেসময় দুপুরের সময় এখনকার চেয়ে অনেক সীমিত ছিল।[৩] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অঞ্চলে সন্ধ্যা বলতে দুপুরের মধ্যভাগ থেকে রাত পর্যন্ত সময় বোঝানো হয়। আইরিশ ভাষায় দুপুরের শেষভাগ ত্থেকে মধ্যরাতের পূর্ব পর্যন্ত সময়কে সংজ্ঞায়িত করার জন্য চারটি শব্দ ব্যবহৃত হয়।[৪] রূপক অর্থে দুপুর বলতে দিনের শেষভাগের সময়কে বোঝানো হয়।
জীবের উপর প্রভাব
[সম্পাদনা]হরমোন ও শরীরের তাপমাত্রা
[সম্পাদনা]যেসব প্রাণী দিনের বেলা জেগে থাকে তাদের করটিসল হরমোনের রক্তের চাপ স্বাভাবিক থাকে। সকালের দিকে এই চাপ হ্রাস পেতে থাকে। এই করটিসল হরমোন রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ানোড় ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে, এছাড়া এটি অতিরিক্ত মানসিক চাপের সময় নিঃসৃত হয়। তবে করটিসলের মাত্রা পরিবেশগত পরিবর্তনের উপরেও নির্ভর করে। মানসিক ও রক্তের চাপ স্থিতিশীল থাকায় গবেষকরা দুপুর বেলা সাধারণত হরমোনের মাত্রা ও মানসিক চাপ পরীক্ষা করে থাকেন। উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া দুপুর বেলা সবচেয়ে বেশি তীব্র থাকে। কারণ এসময় সূর্যের আলোড় উপস্থিতি বেশি থাকে। ফসল ও বিভিন্ন উদ্ভিদের দুপুর বেলা সালোকসংশ্লেষণ হার বেশি থাকায় অধিক পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃশেষিত হয়।[৫]
মানুষের শরীরের তাপমাত্রা সাধারণত দুপুর বেলা সর্বোচ্চ থাকে।[৬][৭] কিন্তু খেলোয়াড় বা শারীরিক পরিশ্রমীদের দুপুরের খাবারের পর তাপমাত্রার এই অধিক হ্রাস পরিলক্ষিত হয় না।[৬] খামার বা গবাদি পশুর থাকার ঘর পূর্ব-পশ্চিম বরাবর নির্মাণ করা হলে উত্তর ও দক্ষিণ আকাশে সূর্যের উপস্থিতি, বিশেষ করে দুপুর বেলা মধ্য আকাশে যূর্যের অধিক রৌদ্র পশুর শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে না। পশুর শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে তাদের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়।[৮]
মানসিক সতর্কতা
[সম্পাদনা]দুপুরের প্রথম ভাগ মানুষের কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতায় প্রভাব রাখে। এসময় গাড়ি দুর্ঘটনা দিনের অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি ঘটে থাকে, বিশেষ করে গাড়ি চালকরা দুপুরের খাবার শেষ করার পরে যখন গাড়ি চালায়। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত পরিচালিত সুইডেনে একটি জরিপে দেখা যায় বিকেল ৫ টায় সবচেয়ে বেশি (১৬০০টি) গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা দিনের অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি। বিকেল ৪টা এবং ৬টায় ১০০০টি করে দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর একটি সম্ভাব্য কারণ দুপুরে রাস্তায় অধিক যানবাহনের চাপ। কিন্তু সকাল বেলাতেও রাস্তায় যানবাহনের আধিক্য থাকলেও সেসময় এত বেশি দুর্ঘটনা ঘটে না।[৯] ফিনল্যান্ডে দুপুর বেলা কৃষিকাজে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে, বিশেষ করে স্পেটেম্বর মাসের সোমবারের দুপুরগুলোতে।[১০]
এক অধ্যাপক পর্যবেক্ষণ করেছেন যে তার শিক্ষার্থীরা দুপুরের সময় পরীক্ষাতে খারাপ ফলাফল করেছে, তবে সন্ধ্যেবেলা আরও বেশি খারাপ করেছে। তবে এই পর্যবেক্ষণ পরিসংখ্যানগত দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ নয়। মানুষের কর্মক্ষমতা দুপুরে হ্রাস পায়। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতাও দুপুরে কমে যায়, কিন্তু সকাল বেলা এতোটা কমে না। সবচেয়ে বেশি হ্রাস পায় শনিবার দুপুরে এবং সবচেয়ে কম হ্রাস পায় সোমবার দুপুরে।[১১] ১৯৫০ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, দুইজন নারী কারখানা-শ্রমিকের কর্মক্ষমতা দুপুর বেলা ১৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল এবং কর্মঘণ্টার শেষ সময়ে এই হ্রাসের পরিমাণ সর্বোচ্চ হয়। তবে এসবের কারণ হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে বিরতি নেয়া এবং কারখানায় অনুৎপাদনশীল কাজে সময় দেয়াকেও দায়ী করা হয়েছে। আরেকটি গবেষণায় দেখা যায় যে, অনেক বেশি সময় ধরে যেসব মানুষ দিনের বেলা কাজ করে, দুপুর বেলা তাদের কর্মক্ষমতা হ্রাসের পরিমাণ অন্যান্য স্বাভাবিক কর্মীদের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে।[১২]
তবে সব মানুষের কর্ম-অভ্যাস সমান নয়। ইতালি এবং স্পেনে অনুষ্ঠিত একটি গবেষণার অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদেরকে একটি প্রশ্নপত্র পূরণ করতে হয়, যার ফলাফলের ভিত্তিতে দিনের বিভিন্ন সময়ে তাদের উৎপাদনশীলতা পর্যবেক্ষণ করা হয়। প্রশ্নপত্র পূরণের সময় সতর্কতা দিনের সময়ের সাথে নির্ভরশীল ছিল বলে পরিলক্ষিত হয়। তবে তাদের প্রায় সবার সতর্কতা বেলা ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ ছিল।[১৩]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Afternoon"। Merriam-Webster। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ৯, ২০১৪।
- ↑ "Noon"। Merriam-Webster। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ৯, ২০১৪।
- ↑ "noon (n.)"। Online Etymology Dictionary। ২০০১। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ১০, ২০১৪।
- ↑ Ekirch 2006, পৃ. xxxii
- ↑ Sinclair ও Weiss 2010, পৃ. 118
- ↑ ক খ Refinetti 2006, পৃ. 556
- ↑ Psychology: An International Perspective- Michael W. Eysenck
- ↑ Aggarwal ও Upadhyay 2013, পৃ. 172
- ↑ Refinetti 2006, পৃ. 559
- ↑ McCabe 2004, পৃ. 471
- ↑ Ray 1960, পৃ. 11
- ↑ Ray 1960, পৃ. 18
- ↑ Refinetti 2006, পৃ. 561
উদ্ধৃত বইসমূহ
[সম্পাদনা]- Aggarwal, Anjali; Upadhyay, Ramesh (২০১৩)। Heat Stress and Animal Productivity। Springer Publishing। আইএসবিএন 978-8-132-20879-2।
- Blaskovich, Jim (২০১১)। Social Psychophysiology for Social and Personality Psychology। আইএসবিএন 978-0-85702-405-3।
- Ekirch, A. Roger (২০০৬)। At Day's Close: Night in Times Past। W. W. Norton & Company। আইএসবিএন 978-0-393-32901-8।
- McCabe, Paul T. (২০০৪)। Contemporary Ergonomics। CRC Press। আইএসবিএন 0-8493-2342-8।
- Ray, James T. (১৯৬০)। Human Performance as a Function of the Work–Rest Cycle। National Academy of Sciences।
- Refinetti, Roberto (২০০৬)। Circadian Physiology (2nd সংস্করণ)। Taylor & Francis Group। আইএসবিএন 978-0-8493-2233-4।
- Sinclair, Thomas M.; Weiss, Albert (২০১০)। Principles of Ecology in Plant Production। University of Nebraska, Lincoln/University of Florida।