সোহেল চৌধুরী: নাইটক্লাবের গেটে নায়কের লাশ - দুই যুগ আগে ঢাকার চাঞ্চল্যকর এক হত্যাকাণ্ড

চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী,

ছবির উৎস, তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী

ছবির ক্যাপশান, চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী, পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
  • Author, সাইয়েদা আক্তার
  • Role, বিবিসি বাংলা, ঢাকা

উনিশশো আটানব্বই সালের ১৮ই ডিসেম্বর ভোর। বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে অবস্থিত ট্রাম্পস ক্লাবের নিচের দরজার সামনে উপুড় হয়ে পড়ে ছিল শরীরটা। চারপাশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

রক্তের ছাপ শুরু হয়েছিল ক্লাবের সিঁড়ির সামনে থেকে।

চারপাশে শত শত মানুষের ভিড়।

উপুড় হয়ে পড়ে থাকা শরীরটা বাংলাদেশের একজন নামী চিত্রনায়কের।

দীর্ঘদেহী, সুদর্শন ওই নায়কের নাম সোহেল চৌধুরী।

আশির দশকের মাঝামাঝি অভিষেক হয় ঢাকাই চলচ্চিত্রে। বিয়ে করেছিলেন আরেক জনপ্রিয় তারকা দিতিকে, যদিও পরে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।

দেশজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ওই হত্যাকাণ্ডের সংবাদ কাভার করার জন্য ১৮ই ডিসেম্বর ভোরে ঘটনাস্থলে হাজির হয়েছিলেন অপরাধ সাংবাদিক কামরুল হাসান।

তিনি বিবিসির কাছে বর্ণনা করছিলেন ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিনি কী দেখেছিলেন।

উপুড় হয়ে পড়ে থাকা শরীরটা তুলে পুলিশ তাকে নিয়ে গিয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন হাসপাতালে আনার অনেক আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।

মি. হাসান বলছিলেন, মি. চৌধুরীর বুকে মাত্র একটা গুলির চিহ্ন ছিল।

তৎকালীন স্ত্রী দিতি এবং সন্তানদের সাথে সোহেল চৌধুরী

ছবির উৎস, তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী

ছবির ক্যাপশান, তৎকালীন স্ত্রী দিতি এবং সন্তানদের সাথে সোহেল চৌধুরী, পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

ট্রাম্পস ক্লাবের নীচে সেইদিন সোহেল চৌধুরীর সাথে থাকা আরো দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।

ঘটনার প্রায় ২৪ বছর পর ৫ই এপ্রিল রাতে ওই হত্যাকাণ্ডের চার্জশিটভুক্ত একজন আসামিকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব।

দুই যুগ পর এক আসামী গ্রেপ্তার

চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরীকে মঙ্গলবার রাতে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব।

বুধবার ব্রিফিংয়ে র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেছেন, বনানীর যে ক্লাবের নিচে সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, সেই ট্রাম্পস ক্লাবের যৌথ অংশীদার ছিলেন আশীষ রায় চৌধুরী।

র‍্যাব বলছে, গ্রেফতার মি. চৌধুরী একাধিক বেসরকারি এয়ারলাইনসের ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন। সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় তিনি একবার আদালত থেকে জামিন নিয়েছিলেন।

ঘটনার পর গুলশান থানায় বাদী হয়ে মামলা করেছিলেন সোহেল চৌধুরীর বড়ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী।

সোহেল চৌধুরী

ছবির উৎস, তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী

ছবির ক্যাপশান, সোহেল চৌধুরী

চব্বিশ বছর আগে ঢাকার অভিজাত এলাকায় ওই হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।

ঢাকার নাইট ক্লাব সংস্কৃতি নিয়ে তখন পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছিল।

কিন্তু ব্যাপক আলোচিত হবার পরেও মামলার কার্যক্রম দেড় যুগের বেশি সময় স্থগিত থাকার পর, ২০২২ সালেই নতুন করে এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

তারই ধারাবাহিকতায় চার্জশিটভুক্ত আসামি আশীষ রায় চৌধুরীর নামে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে মার্চের শেষ দিকে।

চার্জশিটে যা বলা হয়েছিল

উনিশশো নিরানব্বই সালে গোয়েন্দা পুলিশ এই মামলার চার্জশিট দেয়। যে কর্মকর্তা চার্জশিট দিয়েছিলেন তিনি অনেক বছর আগে অবসরে গেছেন।

মামলাটি এখন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন।

সেখানকার সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর সাদিয়া আফরিন শিল্পী বিবিসিকে বলেছেন, চার্জশিটে বলা হয়েছিল, ১৯৯৮ সালের ২৪শে জুলাই ট্রাম্পস ক্লাবে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর বিভিন্ন ইস্যুতে বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়।

এজন্য আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও বান্টি ইসলাম সোহেল চৌধুরীকে 'শিক্ষা দিতে' চান।

চব্বিশে জুলাই ছাড়াও কয়েকবারই সোহেল চৌধুরীর সাথে ট্রাম্পস ক্লাবের অতিথি এবং কর্মীদের "গোলমাল" হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে চার্জশিটে।

ক্লাবটিতে "অসামাজিক কার্যকলাপ, নাচ গান, মদ্যপান" করা হত বলে চার্জশিটে উল্লেখ আছে।

চার্জশিটে বলা হয়, মোট নয়জন এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।

সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর সাদিয়া আফরিন শিল্পী জানিয়েছেন, চার্জশিটের পর ২০০১ সালের ৩০শে অক্টোবর চার্জ গঠনের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল এই মামলার।

মামলার নথি গায়েব, ১৫ বছর দীর্ঘায়িত কার্যক্রম

মামলায় অভিযোগ গঠন হবার পর বিচারের জন্য মামলাটি পাঠানো হয় ২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে।

কিন্তু মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একজন আসামি ২০০৩ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেন।

তার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০০৪ সালে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুলসহ আদেশ দেয়।

কিন্তু ২০১৫ সালের পাঁচই অগাস্ট আদালত রুলটি খারিজ করে হাইকোর্টের দেওয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করার আদেশ দেয়, যার ফলে মামলার বিচার কাজ চালাতে আইনি বাধা দূর হয়।

কিন্তু সেই আদেশ আর নিম্ন আদালতে পৌঁছায়নি।

এ বছরের শুরুতে নতুন করে গায়েব নথি উদ্ধারে একটি রিট করা হয়, আর তারপরই নতুন করে শুরু হয় মামলার কার্যক্রম।

পরিবার কী বলছে?

বিচারাধীন বিষয় বলে মামলা প্রসঙ্গে কোন মন্তব্য করতে চাননি সোহেল চৌধুরীর বড়ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী।

তবে তিনি বলেছেন, মামলায় যেদিনই সমন পেয়েছেন আদালতে হাজির হয়েছেন।

"কিন্তু ২০০১ সালে বিচার শুরু হওয়ার পর আজ পর্যন্ত আমি সাক্ষ্য দিতে পারিনি," আক্ষেপ করে বলছিলেন মি. চৌধুরী।

বিবিসি বাংলায় অন্যান্য খবর: