ঢাকার রাস্তায় প্রকাশ্যে গুলি করে দুজনকে খুন, একজন পথচারী, অপরজন ছিলেন অন্য এক হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামী

বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার শাহজাহানপুরে রাস্তার ওপর ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান, প্রতীকী চিত্র

ঢাকায় বৃহস্পতিবার রাতে প্রকাশ্যে সড়কের উপর অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের গুলিতে একটি জোড়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একজন নিহতের পরিবার শুক্রবার মামলা করেছে।

নিহতদের মধ্যে একজন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন সাবেক নেতা বলে জানা যাচ্ছে। তিনি একটি পুরনো হত্যাকাণ্ডের এজাহারভুক্ত আসামী ছিলেন বলেও জানা যাচ্ছে। যদিও পরে পুলিশের অভিযোগপত্রে তার নাম ছিল না।

ওদিকে ঘটনাস্থলে নিহত অপরজন ছিলেন একজন পথচারী। তিনি একজন কলেজছাত্রী। নিহত আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা ও ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম টিপুর সাথে তার কোন সম্পর্ক ছিল না।

শাহজানপুরের রাস্তায় যানজটের মধ্যে প্রকাশ্যে গুলি করে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি বাংলাদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।

ঘটনার সিসিটিভি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যা দেখে বহু মানুষ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

এ হত্যাকাণ্ডের কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। পুলিশ বলছে তারা এ নিয়ে তদন্ত করছে।

শুক্রবারই মতিঝিল থানায় নিহত মি. ইসলামের পরিবারের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে, যেখানে অজ্ঞাত হামলাকারীদের আসামী করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা বলেছেন, এ ঘটনা রাজনৈতিক কারণে ঘটেছে নাকি অন্য কোন কারণ এর পেছনে রয়েছে তা তদন্ত ও বিচার শেষ হওয়ার পরেই বোঝা যাবে।

ঘটনার বিস্তারিত কী জানা যাচ্ছে?

বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ওই ঘটনার সিসিটিভি ভিডিওতে দেখা যায়, যানজটের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির সামনের সিটের কাছে এসে এক বন্দুকধারী জাহিদুল ইসলাম টিপুকে গুলি করে এবং দৌড়ে রাস্তার উল্টো দিকে চলে যায়।

ওই ভিডিও অবশ্য নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি বিবিসির তরফ থেকে।

মি. ইসলাম একজন ব্যবসায়ী এবং মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। নিহত অপরজন একজন কলেজ শিক্ষার্থী যিনি হামলার গাড়ির পাশে একটি রিকশায় ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে বসে ছিলেন।

ঢাকা মেট্রেপলিটান পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ কমিশনার মোহাম্মদ আহাদ জানান, "মাইক্রোবাসের সামনের সিটে বসা ছিলেন জাহিদুল ইসলাম টিপু। রাস্তার অপর প্রান্ত থেকে রাস্তার বাম পাশে এসে এলোপাথাড়ি গুলি করে এবং পালিয়ে যায়।"

মি. আহাদ জানান 'হেলমেট পরিহিত একজন' জাহিদুল ইসলাম টিপুর দিকে গুলি চালিয়েছিল বলে সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হয়েছেন তারা।

বৃহস্পতিবার রাতে জাহিদুল ইসলাম টিপুকে গুলি করার ঘটনার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায়। মি. ইসলামকে যখন গুলি করা হয়, ঐ মুহূর্তটি ঘটনাস্থলের পাশের একটি দোকানের সিসিটিভি'র ফুটেজে অস্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে।

ভিডিওতে দেখা যায় বেশ কিছু রিকশার যানজটের মধ্যে ধীরগতিতে চলতে থাকা একটি সাদা মাইক্রোবাসের সামনের সিটের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গুলি করে দৌড়ে গাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তার অপর প্রান্তে চলে যায় একজন।

এই পুরো ঘটনাটি ঘটে দশ সেকেন্ডেরও কম সময়ে।

সেসময় কিছুটা যানজট থাকায় রাস্তায় রিকশাগুলো বেশ ধীরগতিতে চলছিল। গুলির শব্দে কয়েকটি রিকশা থেকে যাত্রীরা নেমে দৌড়ে দূরে সরে যান। ফুটপাতে থাকা মানুষজনকেও দ্রুতগতিতে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায়।

গুলি করে বন্দুকধারী দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময়ই গাড়ির পেছনের দরজা খুলে কয়েকজন বের হয়ে আসেন এবং বন্দুকধারী যেদিক দিয়ে পালিয়েছে সেদিকে দৌড়ে যান। পরক্ষণেই তারা দৌড়ে গাড়ির কাছে ফিরে আসেন এবং গাড়ির সামনের সিটের দরজা খুলে গুলিবিদ্ধ জাহিদুল ইসলাম টিপুর কাছে যান।

গুলিবিদ্ধ জাহিদুল ইসলামের কাছে আসার পর জানা যায় যে তার পাশে বসে থাকা ড্রাইভারও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এবং রক্তাক্ত অবস্থায় এক তরুণী পাশে রাস্তায় পড়ে আছে।

আহত অবস্থায় তিনজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়ার পর গুলিবিদ্ধ কলেজ ছাত্রী এবং জাহিদুল ইসলামকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।

আরো পড়তে পারেন:

নিহত তরুণী একজন কলেজছাত্রী

ঘটনাস্থলে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা তরুণী, যাকে হাসপাতালে নেয়ার পর মৃত ঘোষণা করা হয় তার নাম সামিয়া আফরান জামাল।

তিনি ঢাকার বদরুন্নেছা মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন।

বাবা-মায়ের সাথে ঢাকার শান্তিবাগে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি।

ঘটনার সময় সামিয়া তার এক বন্ধুর সাথে রিকশায় খিলগাঁওয়ের দিকে যাচ্ছিলেন বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন তার বাবা জামালউদ্দিন।

ময়নাতদন্তের পর আজই সামিয়ার মরদেহ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করার কথা রয়েছে।

প্রাথমিকভাবে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাদের ধারণা অনুযায়ী সামিয়ার পিঠে গুলি লাগায় তার মৃত্যু হয়েছে।

জাহিদুল ইসলাম দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে

মতিঝিল, শাহজাহানপুর এলাকার স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, পেশায় ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম টিপু তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে মাঠ পর্যায়ের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।

ঠিকাদারী ব্যবসার পাশাপাশি মতিঝিল এলাকায় তার বেশ কিছু দোকানও ছিল বলে জানা যায়।

নব্বইয়ের দশক থেকেই তিনি মতিঝিল এলাকায় ওয়ার্ড পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বলে জানান মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি বশিরুল আলম খান বাবুল।

দুই হাজার নয় থেকে ২০১৬ পর্যন্ত মি. ইসলাম মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন বলে জানান মি. খান।

মি. খান বলেন, "টিপু দীর্ঘসময় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। তবে ২০১৬ সালে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের কোনো সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন না।"

পুরোনো একটি একই ধরণের চাঞ্চল্যকর হত্যার সাথে এই ঘটনার কী সংযোগ?

চাঞ্চল্যকর এই ঘটনাটিও তখন সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল।

নিহত রিয়াজুল হক খান মিল্কী ছিলেন সেসময়কার ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।

ওই ঘটনায় নিহতের পক্ষের যে আইনজীবী তিনি বিবিসিকে বলেছেন, বৃহস্পতিবার রাতে নিহত মি. ইসলাম ওই হত্যাকাণ্ডে দায়ের করা মামলায় একজন এজাহারভুক্ত আসামী ছিলেন।

আবদুল্লাহ আল মনসুর রিপন অবশ্য বলছেন, এজাহারভুক্ত আসামী হলেও পরে দুই দফায় দুটি পৃথক অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ যেগুলোর কোনটিতেই জাহিদুল ইসলাম টিপুর নাম আসেনি।

আওয়ামী লীগ কী বলছে?

এই ঘটনার পেছনে রাজনীতির কোন সংযোগ আছে কি না সে নিয়ে এখনই কোন মন্তব্য করতে রাজী হয়নি আওয়ামী লীগ।

দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বিবিসিকে বলেন, "পুলিশ তদন্ত করবে, তারপর আদালত বিচার করবে। তার আগ পর্যন্ত এটা কোনোভাবেই বলা সম্ভব নয় যে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের কারণ কী।"