ইসরায়েল-হেজবুল্লাহর পাল্টাপাল্টি হামলায় ফের উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য

রোববার লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহর ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান, রোববার লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহর ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী ও লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহর মধ্যে রোববার পাল্টাপাল্টি হামলার যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি ঘিরে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

এমন একটি সময় হামলার এই ঘটনাটি ঘটলো, যখন গাজায় যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

যুদ্ধবিরতির বিষয়ে শিগগিরই কার্যকর একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আশাও প্রকাশ করা হয়েছিলো।

কিন্তু রোববারের ঘটনার পর যুদ্ধবিরতির সেই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হবে কী-না, সেটি নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।

এছাড়া ওই হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল ও হেজবুল্লাহ সরাসরি যুদ্ধে জড়িতে পড়া দ্বারপ্রান্তে রয়েছে কী না, সেই প্রশ্নও উঠছে।

যদিও গত সাতই অক্টোবরের পর দু’পক্ষের মধ্যে বেশ কয়েকবার হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে।

সর্বশেষ রোববার ভোরে দক্ষিণ লেবাননে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। দেশটি দাবি করেছে যে, তাদের ওপর রকেট হামলা চালানোর জন্য হেজবুল্লাহ প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।

সে কারণে নিজেদের রক্ষার্থে আগাম সতর্কতা হিসেবে বিমান হামলা চালানো হয়।

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর ভাষ্যমতে, বিমান হামলা চালিয়ে তারা হেজবুল্লাহর বেশ কয়েক হাজার স্থাপনা গুড়িয়ে দিয়েছে।

অন্যদিকে, ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে প্রায় ৩২০টি রকেট বোমা নিক্ষেপ করে হেজবুল্লাহ। যদিও হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে রকেট উৎক্ষেপণ ব্যবস্থায় ইসরায়েলের হামলার সত্যতা নাকচ করা হয়েছে।

আরও পড়তে পারেন:
লেবাননের বৈরুতের একটি কফিশপের ছবি

ছবির উৎস, EPA

ছবির ক্যাপশান, লেবাননের বৈরুতের একটি কফিশপের ছবি

উল্টো দাবি করা হয়েছে যে, রোববারের রকেট হামলায় ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটি ও গোলান মালভূমির চারটি স্থাপনায় তারা আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে।

সশস্ত্র গোষ্ঠীটি বলেছে, তাদের নেতা ফুয়াদ শুকরের হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে উত্তর ইসরায়েলে রকেট ও ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে।

তবে ইসরায়েলের হামলার নিজেদের তিন যোদ্ধা নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে তারা।

অন্যদিকে, হেজবুল্লাহর রকেট হামলায় ইসরায়েলের নৌবাহিনীর এক সদস্য নিহত হয়েছে। এছাড়া আকরে শহরে কয়েকজন আহত হয়েছে বলেও জানা যাচ্ছে।

পাল্টাপাল্টি হামলার পর পরিস্থিতি আপাতত শান্ত বলেই মনে হচ্ছে। তবে যে কোনো মুহূর্তেই যে অবস্থা পাল্টে যেতে পারে, সেই আশঙ্কাও রয়েছে।

লেভান্ত ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সামি নাদের বলছেন, রোববারের পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

যদিও ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ তেমন পরিস্থিতি এড়ানোর চেষ্টা করবে বলে মনে করছেন তিনি।

“হেজবুল্লাহর ওপর হামলা চালানোর ক্ষেত্রে ইসরায়েল নিজেদের নিরাপত্তা ও ইসরায়েলের নাগরিকদের সুরক্ষার কথা বলছে। এরমধ্য দিয়ে এটাই বোঝা যায় যে, দেশটি আপাতত বড় আকারে সংঘাতে জড়ানোর দিকে হাঁটতে চাচ্ছে না,” বলছিলেন মি. নাদের।

এদিকে, ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাৎসের বরাত দিয়ে বার্তাসংস্থা রয়টার্স বলছে, ইসরায়েল পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ চায় না। তবে তারা পরিস্থিতি দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে বলে জানানো হয়েছে।

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

ছবির উৎস, EVN

ছবির ক্যাপশান, ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

যুদ্ধবিরতি নিয়ে শঙ্কা

গত সাতই অক্টোবরের পর গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। এর প্রতিবাদে দেশটির ওপর বেশ কয়েক দফায় হামলা চালিয়েছে ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহ। ইসরায়েলের পক্ষ থেকেও সেগুলোর পাল্টা জবাব দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু এবার এমন একটি সময় হামলার ঘটনাটি ঘটলো, যখন গাজায় যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

এ লক্ষ্যে সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য সফর করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন।

তার ওই সফরের কিছুদিন আগেই ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার বৈরিতা ও ব্যবধান দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ীভাবে দূর করার লক্ষ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুটা পরিবর্তিত নমনীয় এক প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন।

তারও আগে কাতারের রাজধানী দোহায় গাজাযুদ্ধ নিয়ে দু-পক্ষের মধ্যে আবারও আলোচনা শুরু হয়।

মূলতঃ তারপর থেকেই যুদ্ধবিরতির বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি চুক্তির ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে আসছে।

যদিও যুদ্ধবিরতির বিষয়ে দৃশ্যমান তেমন কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানিয়েছে হামাস।

হামাস জোর দিয়ে বলেছে যে, গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলি সৈন্যদের পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হবে কি-না, সেটি নিয়ে এখনও চুড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

সব মিলিয়ে যুদ্ধবিরতির যে চুক্তির কথা বলা হচ্ছে, সেটি একটি 'ভ্রম' বলে মন্তব্য করে হামাস।

তারপরও ইসরায়েলের সঙ্গে বৈঠক শেষে ব্লিঙ্কেন জানিয়েছিলেন, দ্রুতই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হবে বলে তিনি আশাবাদী।

গত সাতই অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে নজিরবিহীন একটি হামলা চালায় ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। ওই হামলায় ইসরায়েলের অন্তত ১২০০ মানুষ নিহত হয় এবং আড়াইশ জনকে জিম্মি করে হামাস।

এর প্রতিক্রিয়ায় গাজা অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজায় এখন পর্যন্ত ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে

ছবির উৎস, EPA

ছবির ক্যাপশান, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজায় এখন পর্যন্ত ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে

হেজবুল্লাহ কারা?

হামাস হামলা চালানোর পর থেকেই ইসরায়েলে হামলা চালানো শুরু করেছে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহ। সহিংসতার মাত্রা বেড়েছে ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তে।

হেজবুল্লাহর অর্থ সৃষ্টিকর্তার দল। আশির দশকের শুরুর দিকে হেজবুল্লাহ গঠন করেছিল ইরানের রেভলিউশনারি গার্ডস। উদ্দেশ্য ছিল লেবাননে ইসলামিক আন্দোলনের প্রসার ও সেখানে হামলা করা ইসরায়েলিদের সাথে লড়াই। মূলত শিয়া মুসলিমদের নিয়ে গঠন হয় হেজবুল্লাহ।

হেজবুল্লাহ ইসরায়েলের সাথে সবচেয়ে বড় আকারের যুদ্ধ করেছে ২০০৬ সালে। ইসরায়েলের সাথে ৩৪ দিনের সেই যুদ্ধে লেবাননের ১১২৫ এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয় যাদের বেশির ভাগ ছিল সাধারণ নাগরিক। বিপরীতে ইসরায়েলে মৃত্যু হয়েছিল ১৬৪ জনের যাদের বেশির ভাগই ছিল সেনা। এর পর থেকে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করে গেছে গোষ্ঠীটি।

২০১২ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে সুন্নি বিদ্রোহীদের মোকাবেলায় হেজবুল্লাহকে নিয়োগের পর থেকে তাদের সামরিক সক্ষমতা বেড়েছে বলে জানাচ্ছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

ইসরায়েলসহ বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশ নিষিদ্ধ করেছে এই গোষ্ঠীকে।

আরও পড়তে পারেন:
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন

কতটা শক্তিশালী হেজবুল্লাহ?

ইসরায়েল ও হেজবুল্লাহ-র মধ্যেকার সংঘাত যদি শেষ পর্যন্ত পুরোদস্তুর যুদ্ধের দিকে গড়ায়, সেই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে দেখে নেওয়া যেতে পারে তাদের সামরিক শক্তি আসলে ঠিক কতটা!

কোনও দেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনী না হয়েও বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক অস্ত্রসম্ভারে সজ্জিত সামরিক শক্তিগুলোর অন্যতম হল হেজবুল্লাহ। বস্তুত এরকম বাহিনীগুলোর মধ্যে তারাই সবচেয়ে শক্তিশালী, এবং তাদের টাকাপয়সা ও অস্ত্রশস্ত্র জোগায় ইরান।

হেজবুল্লাহ-র প্রধান শেখ হাসান নাসরুল্লাহ-র দাবি অনুযায়ী তাদের প্রায় এক লক্ষ যোদ্ধা আছেন। যদিও বিভিন্ন নিরপেক্ষ সূত্রে এই সংখ্যাটা ২০ থেকে ৫০ হাজারের মধ্যে বলেও বলা হয়।

হেজবুল্লাহ-র এই সদস্যরা সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং তাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও আছে। এদের অনেকেই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধেও লড়াই করেছেন।

স্ট্র্যাটেজিক থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের হিসেব অনুযায়ী, হেজবুল্লাহ-র কাছে প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার রকেট ও মিসাইল আছে। তাদের এই অস্ত্রভান্ডারের বেশিটাই হল ছোট আকারের, আনগাইডেড ভূমি-থেকে-ভূমি আর্টিলারি রকেট।

তবে হেজবুল্লাহ-র সম্ভারে বিমান ও রণতরী-বিধ্বংসী মিসাইল আছে বলেও ধারণা করা হয়। তা ছাড়া বেশ কিছু ‘গাইডেড’ মিসাইলও আছে, যেগুলো ইসরায়েলের অনেক ভেতরে গিয়েও আঘাত হানতে সক্ষম।

গাজা ভূখণ্ডে হামাসের হাতে যে ধরনের অস্ত্রশস্ত্র আছে, তার তুলনায় হেজবুল্লাহ-র এই অস্ত্রভাণ্ডার অনেক বেশি আধুনিক ও বিধ্বংসী।