চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/প্রথম খণ্ড/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
তের
এইভাবে লোক-মুখে-মুখে জয়দেবের প্রেম ও ভক্তির কাহিনী, তাঁর অপরূপ কাব্য-প্রতিভার কথা গৌড়ের রাজসভায় গিয়ে পৌঁছল।
তখন বল্লালসেন গত হয়েছেন। গৌড়ের সিংহাসনে রাজা লক্ষ্মণ সেন। পিতার কাছ থেকে লক্ষ্মণ সেন পেয়েছিলেন, মহত্তর জীবনের প্রতি একটা সুতীব্র অনুরাগ। বল্লালসেন মৃতপ্রায় বাংলার সামাজিক জীবনকে কৌলীন্যের গুণগত বিভাগে এক নতুন প্রেরণা দিয়ে যান। প্রতিদিনের জীবনের গড্ডলিকাপ্রবাহ থেকে জনতার চিত্তকে তিনি মহত্তর অস্তিত্বের, মহত্তর জীবনের দিকে আকৃষ্ট করেন। পিতার সেই আদর্শবাদ পূরামাত্রায় লক্ষ্মণ সেন পেয়েছিলেন। তাই তিনি বাংলাদেশে সঙ্গীত, সাহিত্য, শিল্পকলার পরিপূর্ণ বিকাশের দ্বারা এক উন্নততর জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন এবং সে-যুগের রীতি অনুযায়ী তিনি নিজেকে কাব্য-সঙ্গীত ও শিল্পের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকরূপে জাহির করেন। বিক্রমাদিত্যের নবরত্নের মতন তাঁর মনে এক সুতীব্র বাসনা জেগে ওঠে, তাঁর রাজসভায় তিনি দেশের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাদের স্থান দেবেন। তাই দেখি, তাঁর সভায় সে-যুগের বাংলার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ কবিদের সম্মেলন। এইভাবে দেখি তাঁর রাজসভায় কবি উমাপতি ধর, গোবর্দ্ধন আচার্য্য, কবি শরণ ও কবি ধোয়ী এবং করি জয়দেব মিশ্র। এই বিশ্বমণ্ডলীর মধ্যে কবি জয়দেবের নামের সঙ্গেই আমরা সবিশেষ পরিচিত। বিক্রমাদিত্যের সভায় কালিদাসের মতন, লক্ষ্মণ সেনের রাজসভায় কবি জয়দেবের নাম ও কীর্ত্তিই তাঁর রাজসভাকে অমর করে রেখেছে।
একান্ত দুঃখের বিষয়, বাংলার এই সব শ্রেষ্ঠ কবি-প্রতিভাদের দান আজ কালগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। কবি উমাপতি ধর লক্ষ্মণ সেনের সভা-কবিদের মধ্যে সব চেয়ে বয়সে প্রবীণ ছিলেন। তিনি বল্লাল সেনের আমলের লোক এবং কিছুকাল তাঁর মন্ত্রিত্ব পর্য্যন্ত করেছেন। গোটাকতক টুকরো টুকরো কবিতা ছাড়া তাঁর সৃষ্টির আর কিছু পাওয়া যায় না। কবি জয়দেব তাঁর সমালোচনা করে বলেছিলেন, বাচঃ পল্লবয়ত্যুমাপতিধরঃ অর্থাৎ কবি উমাপতি ধরের একটা বিশেষ লক্ষণ ছিল যে, তিনি শব্দের ওপর বড় বেশী নজর দিতেন, তাঁর কাব্য-প্রতিভার লক্ষ্য ছিল, শব্দকে পল্লবিত করে তোলা।
লক্ষ্মণ সেনের রাজসভায় কবি-প্রতিভাতে যেমন কবি জয়দেবের স্থান ছিল অগ্রগণ্য, তেমনি তেজস্বিতায় এবং পাণ্ডিত্যে প্রধান স্থান ছিল গোবর্দ্ধন-আচার্য্যের। তাঁর নির্ভীকতার কতকগুলি গল্প প্রচলিত আছে। সেই সব গল্প থেকে বোঝা যায়, তখনও ব্রাহ্মণের তেজ, ন্যায়নিষ্ঠা, তাঁর সত্যবাদিতা রাজার আসনকে পর্য্যন্ত টলিয়ে দিতো। কবি জয়দেবের সমসাময়িক সমাজের চিত্রস্বরূপ গোবর্দ্ধন আচার্য্যের একটা কাহিনী বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না।