বিষয়বস্তুতে চলুন

দীক্ষা (ভারতীয় ধর্ম)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
১৯৭৯ সালে ইসকন দীক্ষা অনুষ্ঠানের সময় সৎস্বরূপ দাস গোস্বামী

দীক্ষা (সংস্কৃত: दीक्षा) হলো "ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি বা পবিত্রতা" অর্জন।[] মূলত দীক্ষা বা মন্ত্রদীক্ষা হলো হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈনশিখ ধর্মের মতো ভারতীয় ধর্মে গুরু কর্তৃক শিষ্যকে মন্ত্র শিক্ষা দেওয়ার রীতি। সাধারণত দীক্ষা গ্রহণ অনুষ্ঠানে গুরুর আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলা গ্রহণ অন্তর্ভুক্ত থাকে।[]

দীক্ষা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত মূল "দা" (দিতে) ও "কসি" (ধ্বংস) থেকে অথবা পর্যায়ক্রমে ক্রিয়া মূল "দইক্সা" (পবিত্র করা) থেকে।[] দীক্ষার মাধ্যমে গুরু এবং শিষ্যের মন এক হয়ে যায়।[] দীক্ষার মাধ্যমে ঐশ্বরিক অনুগ্রহ দানকে কখনও কখনও শক্তিপাত বলা হয়।[]

প্রকার

[সম্পাদনা]

বিভিন্ন ঐতিহ্য ও সম্প্রদায় দীক্ষাকে বিভিন্ন উপায়ে অনুশীলন করে। দীক্ষা প্রধানত দ্বিবিধ বহির্দীক্ষা ও অন্তর্দীক্ষা। বহির্দীক্ষায় পূজা, হোম প্রভৃতি বাহ্যিক অনুষ্ঠান বিহিত; আর অন্তর্দীক্ষায় মানুষের কুন্ডলিনীশক্তির (আত্মশক্তি) জাগরণ ঘটে। কোনো কোনো তন্ত্রে ত্রিবিধ দীক্ষার কথা বলা হয়েছে, যথা শাম্ভবী, শাক্তী ও মান্ত্রী।[] তন্ত্র পাঁচ ধরনের দীক্ষার কথা উল্লেখ করে: সমায়-দীক্ষা (আচারের সহিত সম্পন্ন করা হয়); স্পর্শ-দীক্ষা (আচার ছাড়া সম্পন্ন করা হয়); যোনি-দীক্ষা (শব্দ বা মন্ত্র দ্বারা সম্পন্ন হয়) ; সম্ভভি-দীক্ষা (গুরুর বাহ্যিক রূপের উপলব্ধি থেকে উদ্ভূত হয়) এবং মনো-দীক্ষা (যখন দীক্ষা মনের মধ্যে সঞ্চালিত হয়)।[] ইসকনের সদস্যদের জন্য প্রথম দীক্ষা, বা হরিনামা-দীক্ষা, অগ্নি বলির অংশ হিসাবে সঞ্চালিত হয় যেখানে উৎসর্গের জন্য খোলা আগুনে শস্য, ফল ও ঘি রাখা হয়।[] লাহিড়ী মহাশয়ের ঐতিহ্যে ক্রিয়া যোগে দীক্ষা দেওয়া হয়।[] বাঙালি সাধু আনন্দময়ী মা প্রায়ই স্পর্শ দীক্ষা (ঐশ্বরিক স্পর্শ) বা ড্রীক দীক্ষা (তার চেহারা দিয়ে) দিতেন, যেখানে তিনি শক্তিপাত (ঐশ্বরিক অনুগ্রহ) প্রদান করতেন।[]

আরেক ধরনের দীক্ষা, সন্ন্যাসী আদেশে, ব্রহ্মচর্য, সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পদ ত্যাগ ও পারিবারিক বন্ধন সহ সমস্ত জাগতিক কর্তব্যগুলির ব্রত জড়িত। জৈনধর্মে দীক্ষার একই অর্থ রয়েছে। জৈনধর্মে দীক্ষাকে চারিত্রা বা মহানবিষ্ক্রমণও বলা হয়। হিন্দুধর্মে দীক্ষা নেওয়া ব্যক্তি এবং হিন্দু গোষ্ঠীর উপর নির্ভর করে বেশ কয়েকটি আচার অনুষ্ঠান সম্পাদন করা জড়িত।

বিভিন্ন তান্ত্রিক কাজ বিভিন্ন ধরনের দীক্ষা আচার গণনা করে:[১০]

  • কৃয়াবতী
  • কালাবতী
  • বর্ণময়ী
  • বেদময়ী

সকল বর্ণের হিন্দুরাই দীক্ষা গ্রহণের অধিকারী। কোনো কোনো তন্ত্রমতে দীক্ষাদানে নিজের মা সর্বোত্তম গুরু। দীক্ষাদানকারী গুরুকে কেন্দ্র করে কালক্রমে একেকটি সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। সম্প্রদায়গুলির নিজস্ব কিছু আচার-আচরণ থাকে যা একটি থেকে অপরটি ভিন্ন। বাংলাদেশে এরূপ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায়: অনুকূল সম্প্রদায়, মানিক সম্প্রদায়, মতুয়া সম্প্রদায়, জগদ্বন্ধু সম্প্রদায় প্রভৃতি। স্মৃতিনিবন্ধকার রঘুনন্দন বঙ্গদেশে তান্ত্রিক দীক্ষার প্রবর্তন করেন।[]

গুরুত্ব

[সম্পাদনা]

বিষ্ণু যমলা (তন্ত্র) মতে, "যে প্রক্রিয়াটি দিব্য জ্ঞান (আধ্যাত্মিক জ্ঞান) প্রদান করে এবং পাপ ও অজ্ঞতার বীজকে ধ্বংস করে, সেই আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের দ্বারা দীক্ষা বলা হয় যারা সত্য দেখেছে।"[১১] জীব গোস্বামী[১২][১৩] উল্লেখ করেছেন, “দিব্য জ্ঞানং যতো দদ্যাৎ কুর্যাৎ পাপস্য সংক্ষয়ম তস্মাৎ দীক্ষেতি সা প্রোক্তা দেশিকৈস্তত্ত্ব কোবিদৈ: (ভক্তি সন্দর্ভ-২৮৩)। যা থেকে অপ্রাকৃত দিব্য জ্ঞানের উদয় হয় এবং পাপের সর্বতোরূপে ক্ষয় হয়, তত্ত্বশাস্ত্রবিৎ পণ্ডিতেরা তাকেই দীক্ষা বলে বর্ণনা করেছেন। পারদের সংস্পর্শে রাসায়নিক ক্রিয়ার প্রভাবে কাঁসা যেমন সোনায় পরিণত হয়। তেমনি যথাযথভাবে দীক্ষা গ্রহণের ফলে মানুষ ব্রাহ্মণোচিত সমস্ত গুণাবলি অর্জন করেন।

আরো দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "Monier-Williams Sanskrit-English Dictionary"University of Cologne। পৃষ্ঠা d। জানুয়ারি ১০, ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৪-১৯ 
  2. Coward, Harold G.; David J. Goa (২০০৪)। Mantra: hearing the divine in India and AmericaColumbia University Pressআইএসবিএন 978-0-231-12960-2 
  3. Grimes, John A. (১৯৯৬)। A concise dictionary of Indian philosophy। SUNY Press। পৃষ্ঠা 117। আইএসবিএন 978-0-7914-3067-5 
  4. "Archived copy"। ২০১১-০৩-১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-১১-২৬ 
  5. দীক্ষা, সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
  6. The madness of the saints by June McDaniel, University of Chicago Press, (1989) p. 106 আইএসবিএন ০-২২৬-৫৫৭২৩-৫
  7. Introduction to New and Alternative Religions in America [Five Volumes]Eugene V. Gallagher, W. Michael Ashcraft (2006) Greenwood Publishing Group, p. 23 আইএসবিএন ০-২৭৫-৯৮৭১৩-২
  8. Yogananda, Paramhansa (২০০৩)। Autobiography of a Yogi। Sterling Publishers Pvt. Ltd। পৃষ্ঠা 102। আইএসবিএন 978-81-207-2524-9 
  9. Hallstrom, Lisa Lassell (১৯৯৯)। Mother of Bliss: Ānandamayī Mā (1896-1982)। Oxford University Press US। পৃষ্ঠা 140–144। আইএসবিএন 978-0-19-511647-2 
  10. Jnana Sankalini Tantra by Paramahamsa Prajnanananda
  11. Pandey, Vraj Kumar (২০০৭)। Encyclopaedia of Indian philosophy। Anmol Publications। আইএসবিএন 978-81-261-3112-9 
  12. Jiva Goswami
  13. "Life of Srila Jiva Goswami"। ২৩ মার্চ ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১