ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ
শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারবর্গ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে অনাক্রম্যতা বা শাস্তি এড়াবার ব্যবস্থা প্রদানের জন্য বাংলাদেশে “ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ” আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন।
পটভূমি
[সম্পাদনা]প্রথমবার মুজিব শাসনামলে ১৯৭২ সালে এক সরকারি অধ্যাদেশ জারি করে মুক্তিযুদ্ধকালের সব কর্মকাণ্ড, ঘটনাবলি এবং যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বিশেষদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল সংসদে স্বীকার করেন যে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নাগাদ কৃত কার্যকলাপের দায়মুক্তি দিয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘মুক্তিযোদ্ধাদের’ ‘ইমিউনিটি’ বা দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ তাঁদের দ্বারা সংঘটিত কোনো কিছু ‘অপরাধ’ হিসেবে দেখা হবে না। ফলে ‘বিহারি’র বাড়ি-দোকান দখল জায়েজ হয়ে যায়। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে মতিঝিলে শেখ ফজলুল হক মনি উর্দু দৈনিক পাসবান-এর অফিস ও প্রেস দখল করে দায়মুক্তি পেয়ে যান। সেখান থেকে তিনি বাংলার বাণী পত্রিকা প্রকাশ করতে থাকেন।
দ্বিতীয়বার ৬ মে ১৯৭৪ জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে দায়মুক্তি দিয়ে অনুরূপ অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। যেহেতু বাংলাদেশ সংসদ অধিবেশনে ছিল না, সেক্ষেত্রে শেখ মুজিবের একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ কর্তৃক একটি অধ্যাদেশের আকারে ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫ সালে এ আইনটি প্রণীত হয়। এবং শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর তিনিই দেশটির রাষ্ট্রপতি হন। এটি ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নং ৫০ নামে অভিহিত ছিল। এটা ছিল তৃতীয়বার বাংলাদেশে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। পরে ১৯৭৯ সালে সংসদ কর্তৃক এটি অনুমোদন করা হয়। যার ফলে এটি একটি আনুষ্ঠানিক আইন হিসেবে অনুমোদন পায়। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে এ আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[১]
২০০১-২০০৪ সালে চারদলীয় জোট সরকার 'অপারেশন ক্লিন হার্টকে দায়মুক্তি দিয়ে আরেকটি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে।
২০০৯ সালে চৌদ্দ দলীয় জোট সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাতাদের একধরনের দায়মুক্তি দেন। ‘দ্রুত বিদ্যুৎ জ্বালানি সরবরাহ আইন’-এর আওতায় টেন্ডার ছাড়াই প্রকল্প অনুমোদন দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো কুইক রেন্টাল ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প।
প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস এর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক ২০২৪ সালে ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত তরুণদের কর্মকাণ্ডকে একধরনের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনকারী পক্ষ বলছে, এ সময়ে ঘটে যাওয়া ধ্বংসাত্মক কাজগুলোর দায় তারা নেবে না। যেমন মেট্রোস্টেশন পোড়ানো, থানায় আগুন দিয়ে পুলিশ মারা ইত্যাদি। বলা হচ্ছে, এসব হলো ‘মব ভায়োলেন্স’, যার জন্য আন্দোলনকারীরা দায়ী নন। অন্যদিকে ক্ষমতাচ্যুত পক্ষ বলছে, আন্দোলনের ফলেই ‘মব ভায়োলেন্স’ সংঘটিত হয়েছে। তারা বারবার পুলিশ হত্যার উদাহরণ টানছে। আন্দোলনকারীদের দায়মুক্তি দেওয়ার সমালোচনা করছে তারা।
বাতিল
[সম্পাদনা]শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করেন। এটি শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের বিচারের পথ প্রশস্ত করেছিল। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ হাইকোর্ট।
মুজিব হত্যাকাণ্ডের বিচার
[সম্পাদনা]দীর্ঘ ২১ বছর পরে আওয়ামীলীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য শুরু করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের কাজ শুরু হয় ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমণ্ডি থানায় মামলা দায়ের এর মাধ্যমে। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তারিখে মামলার যাবতীয় কার্যক্রম শেষে পনেরো (১৫) জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। আসামি পক্ষের পনেরো জন উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পান। উক্ত আপিলে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল এবং ৩ জনকে খালাস প্রদান করা হয়। তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এলে এ মামলার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পরে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় লাভের পর আওয়ামীলীগ সরকার আবার এ বিচারকার্য চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০০৯ সালে লিভ-টু-আপিল-এর মাধ্যমে এ বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আপিল শেষে বারো জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন মহামান্য আদালত। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি তারিখে এদের মধ্যে পাঁচ জনের ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। দীর্ঘদিন পর পলাতক এক আসামি গ্রেফতার হলে ১২ই এপ্রিল,২০২০ তারিখে তার ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। বাকি পাঁচ জন এখনও বিভিন্ন দেশের আশ্রয়ে পলাতক। পলাতকদের মধ্যে একজন এরই মাঝে বিদেশের মাটিতে মৃত্যুবরণ করেছেন।
শেখ মুজিবের ঘাতকদের তালিকা
[সম্পাদনা]১. লে. কর্নেল শরিফুল হক (ডালিম) (পলাতক)
২. লে. কর্নেল আজিজ পাশা (২০০১ সালে মারা যান)
৩. কর্নেল ফারুক রহমান (ফাঁসি কার্যকর, জানুয়ারি ২৭, ২০১০)
৪. কর্নেল কিসমত হাশেম (পলাতক)
৫. মেজর বজলুল হুদা (ফাঁসি কার্যকর, জানুয়ারি ২৭, ২০১০)
৬. মেজর শাহরিয়ার রশিদ (ফাঁসি কার্যকর, জানুয়ারি ২৭, ২০১০)
৭. মেজর রাশেদ চৌধুরী (পলাতক)
৮. মেজর নূর চৌধুরী (পলাতক)
৯. মেজর শরিফুল হোসেন (পলাতক)
১০. মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ফাঁসি কার্যকর, জানুয়ারি ২৭, ২০১০)
১১. লে. খায়রুজ্জামান (পলাতক)
১২. লে. নাজমুল হোসেন (পলাতক)
১৩. ল্যান্সার মহিউদ্দিন (ফাঁসি কার্যকর, জানুয়ারি ২৭, ২০১০)
১৪. ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ (ফাঁসি কার্যকর, ১২ই এপ্রিল, ২০২০)
১৫. লে. কর্ণেল আবদুর রশীদ (সেন্টু) (পলাতক)
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ দৈনিক জনকণ্ঠ (সেপ্টেম্বর ৮, ২০১৭)। "ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সুবিধাভোগী"। সংবাদপত্র। ২৭ মার্চ ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ৮, ২০১৮।