আন্তর্জাতিক মানবিক আইন
আন্তর্জাতিক মানবিক আইন হচ্ছে সে আইন যেটি যুদ্ধের আচরণবিধি নিয়ন্ত্রণ করে। এটি হল আন্তর্জাতিক আইনের একটি শাখা যেটি যুদ্ধের উপায় এবং পদ্ধতিসমূহকে সীমিত এবং নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে যেসব মানুষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে না তাদেরকে রক্ষা করার মাধ্যমে সশস্ত্র সংঘাতের প্রভাব কমিয়ে আনার চেষ্টা করে। মানবতা এবং মানব-কষ্ট প্রশমনের গুরুত্ব উপলব্ধির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুপ্রাণিত হয়। "এটি কিছু নিয়ম-নীতি এবং প্রতিষ্ঠিত চুক্তি বা প্রথা নিয়ে গঠিত হয়, যেগুলো সশস্ত্র সংঘাতের সময় যেসব পক্ষ থাকে তাদের যুদ্ধের পছন্দের পদ্ধতি ও উপায়সমূহকে সীমিত করার মাধ্যমে ব্যক্তি ও সম্পদ বা বস্তু যেগুলা সংঘাতের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাদেরকে রক্ষা করার প্রয়াস চালায়"।এটিতে রয়েছে জেনেভা কনভেনশন এবং হেগ কনভেনশন, সেই সাথে সংশ্লিষ্ট পরবর্তী চুক্তিসমূহ, মামলা থেকে উদ্ভূত আইন, এবং প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন। এটি যুদ্ধরত দেশসমূহ, নিরপেক্ষ দেশসমূহ, এবং একক ব্যক্তিসমূহ যারা যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে তাদের একে অন্যের প্রতি এবং সুরক্ষিত ব্যক্তিদের প্রতি যে আচরণবিধি এবং দায়িত্ব রয়েছে সেগুলোকে সংজ্ঞায়িত করে। মানবিক উদ্বেগ এবং সামরিক প্রয়োজনীয়তার মধ্যে ভারসাম্য স্থাপনই হল আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের উদ্দেশ্য। এটি যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক প্রভাব সীমিতকরণ এবং মানব-কষ্ট প্রশমণের মাধ্যমে যুদ্ধকে আইনের শাসনের গন্ডির মধ্যে নিয়ে আসে।আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের মারাত্মক লঙ্ঘনকে বলা হয় যুদ্ধাপরাধ। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন যুদ্ধ বা সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত সামরিক শক্তিসমূহের আচরণবিধি নিয়ন্ত্রণ করে। এটি jus ad bellum থেকে পৃথক, যেটি যুদ্ধ বা সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হওয়া নিয়ন্ত্রণ করে এবং শান্তি-বিরোধী অপরাধ এবং আগ্রাসী যুদ্ধ যেটির গন্ডিভুক্ত। jus in bello এবং jus ad bellum একত্রে সমর আইনের দুইটি সূত্র গঠন করে এবং আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সংঘাতসমূহের সকল দিক নিয়ন্ত্রণ করে।
যেসব রাষ্ট্র উপযুক্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহ দ্বারা আবদ্ধ সেসব রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক মানবিক আইন মানতে আজ্ঞাধীন। যুদ্ধের অন্যান্য আরো প্রথাগত অলিখিত নিয়ম রয়েছে, যেগুলোর বেশীরভাগই ন্যূরেমবার্গ ওয়ার ট্রায়ালস্ এর সময় পরীক্ষীত হয়েছিল। সংযোজনের মাধ্যমে সে নিয়মসমূহ সামরিক শক্তিসমূহের স্বীকৃত অধিকার এবং অনিয়মিত বাহিনী এবং অসাক্ষরকারীদের সাথে তাদের আচরণবিধিকেও সংজ্ঞায়িত করে।
আন্তর্জাতিক মানবিক আইন, আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সংঘাত এবং অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাতে প্রযোজ্য আইনসমূহের মধ্যে একটি প্রখর বিভেদ রেখে কাজ করে। এই দ্বিবিভাজন ব্যাপকভাবে সমালোচিত।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের সম্পর্কের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্কিত। এই আলোচনাটি আন্তর্জাতিক আইনের খণ্ডিতকরণের উপর বৃহত্তর আলোচনার একটি অংশ। যেখানে নানাত্ববাদী পন্ডিতগণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনকে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের চেয়ে পৃথক হিসেবে বিবেচনা করে, সেখানে সাংবিধানিক পথের প্রবক্তাগণ আন্তর্জাতিক মানবিক আইনকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। সংক্ষেপে, যারা পৃথক, স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রচলিত ব্যবস্থাকে সমর্থন করে তারা প্রায়োগিক পার্থক্যের উপর জোর দেয়; অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মানবিক আইন শুধুমাত্র সশস্ত্র সংঘাতের সময় প্রযোজ্য। অপরপক্ষে, একটি অধিকতর প্রণালীবদ্ধ পরিপ্রেক্ষিত ব্যাখ্যা দেয় যে, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের একটি কাজের প্রতিনিধিত্ব করে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে রয়েছে কিছু সাধারণ নিয়ম যেগুলো সবার ক্ষেত্রে সবসময় প্রযোজ্য, সেইসাথে রয়েছে কিছু বিশেষ নিয়ম যেগুলো কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য, যেমন সশস্ত্র সংঘাত ও সামরিক দখল (যথা, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন), অথবা কোনো নির্দিষ্ট জনসংখ্যা, যেমন শরনার্থী (রিফিউজি কনভেনশন ১৯৫১), শিশু (কনভেনশন অন দ্য রাইটস্ অফ দ্য চাইল্ড ১৯৮৯), এবং যুদ্ধবন্দীর(থার্ড জেনেভা কনভেনশন ১৯৫৯) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো তাদের রাষ্ট্রাধীন অধিক্ষেত্রে অবস্থানরত সকলের অধিকার রক্ষা করার চেষ্টা করে।
আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের দুইটি ঐতিহাসিক ধারাঃ জেনেভা আইন এবং হেগ আইন
আধুনিক আন্তর্জাতিক মানবিক আইন দুইটি ঐতিহাসিক ধারা গঠিতঃ
১. হেগ আইন, যেটি পূর্বে যুদ্ধের যথোপযুক্ত আইন হিসেবে উল্লেখিত হয়েছিল; এবং
২. জেনেভা আইন, বা মানবিক আইন।
, এবং সংঘাত সম্পর্কিত চুক্তিসমূহকে সুবিন্যস্ত করে যে আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলো হয়েছিল, সেগুলোর মাধ্যমে উদ্ভূত হয়েছিল। এর মধ্যে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি হল ১৮৯৯ এবং ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের হেগ কনভেনশন এবং , যেটি প্রথম ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত হয়েছিল। এই আইন দুইটির উভয়েই jus in bello নিয়ে কাজ করে, যেটি সশস্ত্র সংঘাতের সময় কিছু নির্দিষ্ট আচরণ বা পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য কি না সে প্রশ্ন নিয়ে কাজ করে।
হেগ আইন, বা সমীচীন যুদ্ধের আইন, "অপারেশন পরিচালনার ক্ষেত্রে যুদ্ধবাজদের অধিকার এবং কর্তব্যগুলো নির্ধারণ করে এবং ক্ষতি করার যে পদ্ধতিগুলো রয়েছে সেগুলোকে সীমিত করে"। বিশেষত এটি, যোদ্ধা বা যুদ্ধে লিপ্তদের সংজ্ঞায়নে নিযুক্ত থাকে; যুদ্ধের পদ্ধতি এবং উপায় সম্পর্কিত নিয়মনীতিগুলো প্রতিষ্ঠা করে; এবং সামরিক উদ্দেশ্যের ইস্যূগুলোকে পরীক্ষা করে।
মূল প্রবন্ধ : যুদ্ধ আইন
যুদ্ধবিগ্রহে বর্বরতা রোধ করার রীতিবদ্ধ প্রয়াস শুধুমাত্র ১৯ শতকে বিকশিত হতে শুরু হয়। এই চেষ্টা, আলোকিত যুুুগের দ্বারা প্রভাবিত রাষ্ট্রসমূহের যুদ্ধবিগ্রহে পরিবর্তনশীল দৃশ্য তৈরীতে সমর্থ হয়। যুদ্ধবিগ্রহের উদ্দেশ্য ছিলো শত্রু রাষ্ট্রকে জয় করা নেওয়া, যেটি শত্রুসৈন্যদের নিষ্ক্রিয় করার মাধ্যমেও করা যেতো। এভাবে, "সামরিক ও অসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে পার্থক্য, যুদ্ধাহত এবং আটককৃত শত্রুসৈন্যদের সাথে মানবিকভাবে আচরণ করার প্রয়োজনীয়তা, এবং বাসস্থান যে অবশ্যই দিতে হবে, আধুনিক আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের কিছু স্তম্ভ, এই সবই এই নীতি থেকে উদ্ভূত হয়"।
জেনেভা আইন
সশস্ত্র সংঘাতে অসামরিক ব্যক্তিদের নির্বিচারে হত্যার রয়েছে একটি দীর্ঘ এবং অন্ধকার ইতিহাস। এই দীর্ঘ ইতিহাস থেকে চিহ্নিত কিছু উদারহরণের মধ্যে রয়েছে ভারতে অশোক কর্তৃক কলিঙ্গদের গণহত্যা; ১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেম দখলের সময় ক্রসেডারদের দ্বারা মুসলিম এবং ইহুদীদের গণহত্যা; মঙ্গোলীয় আক্রমণের সময় মঙ্গোলীয়দের কর্তৃক নির্বিচারে হত্যা, যেমন বাগদাদ ধ্বংসের সময় যে গণহত্যা; এবং তৈমুর কর্তৃক ভারতীয়দের নির্বিচারে হত্যা। ফ্রিটজ্ মাঞ্চ ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বের ঐতিহাসিক সামরিক নীতিগুলোকে সারসংক্ষেপ করে: "যে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো পাওয়া যায় সেগুলো হল: যুদ্ধে এবং সামরিক শক্তি দ্বারা দখলকৃত শহরগুলোতে, সামরিক এবং অসামরিক ব্যক্তিদের হত্যা করা হতো এবং সম্পদ ধ্বংস বা লুট করা হতো।" ১৭শ শতাব্দিতে ডাচ আইনজ্ঞ হুগো গ্রোটিয়াস, যাকে ব্যাপকভাবে পাবলিক আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিষ্ঠাতা বা জনক হিসেবে ধরা হয়, লিখেন যে " তাদের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে যুদ্ধকে অস্বীকার করতে পারে না, তাদেরকে অবশ্যই শক্তি এবং আতঙ্ককে তাদের সর্বোচ্চ উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে নিযুক্ত করতে হবে।"
ইতিহাসে মানবিক আদর্শ
হত্যাকাণ্ডের ইতিহাসের মধ্যেও, মানবিক আদর্শগুলোকে বারবার অভিব্যক্ত ও আবাহন করা হয়েছে যাতে সশস্ত্র সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্তরা: আহত,অসুস্থ এবং ধ্বংসপ্রাপ্তদের সুরক্ষা দেওয়া যায়। এসব প্রাচীন যুগের কথা।
ওল্ড টেস্টামেন্ট বা বাইবেলের প্রথম অংশে, ইসরায়েলের রাজা, নবী আল-ইয়াসার শত্রু বন্দীদের ক্ষমা করে দেওয়ার উপদেশ অনুসরণ করে বন্দীদের হত্যা আটকে দেয়। রাজার করা একটি প্রশ্নের জবাবে আল-ইয়াসা বলেন, "তুমি তাদের হত্যা করবে না। তুমি কি তাদের হত্যা করবে যাদের তুমি তোমার তলোয়ার এবং ধনুক দিয়ে বন্দী করেছো? তাদের সামনে রুটি এবং পানি রেখে দাও, যাতে তারা আহার এবং পান করে এবং তাদের মনিবের কাছে চলে যায়।"
প্রাচীন ভারতে, কোন ধরনের হাতিয়ারগুলো ব্যবহার করা উচিত নয় তা বর্ণনা করে দলিল(যেমন মনু আইন) পাওয়া যায়: "যখন সে যুদ্ধে শত্রুদের সাথে লড়ে, তাকে গুপ্ত হাতিয়ার, বা কণ্টকময়, বিষমিশ্রিত, বা যেটির আগায় আগুনের শিখা জ্বলমান সেসব হাতিয়ার দ্বারা আঘাত করতে দিও না।" এবং হিজড়া, যেসব শত্রু হাতজোড় করে মিনতি করে, যে ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছে, যে বর্ম হারিয়েছে, যে নগ্ন, যে নিরস্ত্র, যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে না, এসব ব্যক্তিদের আক্রমণ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইসলামিক আইন বর্ণনা দেয় যে,"অসামরিক ব্যক্তি যেমন, নারী, শিশু, সন্ন্যাসী, তপস্বী, বৃদ্ধ, অন্ধ এবং উন্মাদ যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি তাদের" উৎপীড়ন করা যাবে না। প্রথম খলিফা আবু বকর, ঘোষণা করেন," অঙ্গচ্ছেদ করো না। শিশু বা বৃদ্ধ লোক বা বৃদ্ধা নারীদের হত্যা করো না। তাল গাছের মাথা কেটো না বা পুড়িয়ে দিও না। ফলবান বৃক্ষ কর্তন করো না। খাদ্যের প্রয়োজন ছাড়া গবাদি পশু হত্যা করো না"। ইসলামিক আইনজ্ঞদের মতে বন্দীদের হত্যা করা উচিন নয়, কেননা তাকে "নিছক যুদ্ধাবস্থার জন্য দায়ী করা যাবে না"।
যেহেতু ইসলাম একটি বাস্তবসম্মত ও যথার্থ বিধান তাই বাস্তবতা, যথার্থতা কার্যকর মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামিক আইন সকল অসামরিক ব্যক্তিদের ক্ষমা করে দেয়নি। যারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার জানাতো, বা বিকল্প কর আদায় করতে অস্বীকার জানাতো, মুসলিমরা তাদের যে কাউকেই নীতিগতভাবে হত্যা করতে পারতো, তবে শর্ত ছিলো যে তাদের বিশ্বাসঘাতকতা এবং অঙ্গছেদনের মাধ্যমে হত্যা করা যাবে না"।