আপার্টহাইট (আফ্রিকান্স ভাষায়: Apartheid আপার্ট্‌হাইট্‌, অর্থাৎ "পৃথকীকরণ") বলতে ১৯৪৮ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ-বৈষম্যমূলক নীতিকে বোঝানো হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার আফ্রিকান্স ভাষায় "আপার্টহাইট" কথাটির অর্থ "পৃথকীকরণ" বা জাতিগত পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে পৃথক আবাসন ব্যবস্থা। শ্বেতাঙ্গশাসিত সরকার এসময় আইন করে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিবাসীদের কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ, দক্ষিণ এশীয়, বর্ণসংকর, ইত্যাদি বর্ণে ভাগ করে এবং মূলত অশ্বেতাঙ্গদের বাসস্থান নির্বাচনের অধিকার, যাতায়াতের অধিকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।

আপার্ট্‌হাইট আমলের একটি বিজ্ঞপ্তি: "শ্বেতাঙ্গদের ব্যবহারের জন্য। এই সাধারণ সুবিধা ও সম্পত্তি কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গদের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত। আদেশক্রমে: প্রাদেশিক সচিব"

ইতিহাস

সম্পাদনা

১৯৩০ সালে প্রথম এই শব্দের উৎপত্তি হয় এবং ১৯৪০-এর দশকের শুরু থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক স্লোগানে এই শব্দটি ব্যবহার শুরু করে। তবে শব্দটির সাথে জড়িত যে নীতি তার উদ্ভব আরও আগে। ১৬৫২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাতে শ্বেতাঙ্গ মানুষের বসতি স্থাপন শুরুর সাথে সাথে এই নীতির প্রচলন শুরু হয়।

ঔপনিবেশ

সম্পাদনা

১৬৫২ সালে ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দক্ষিণ আফ্রিকায় কেপ টাউন শহর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কেপ কলোনি স্থাপন করেছিল। ১৭৯৫ সালে ব্রিটিশরা কেপ কলোনি দখল করে নেয়। ব্রিটিশরা মূলত দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার বিরতির জন্য বিশ্রাম ও দাস ব্যবসার উদ্দেশ্যে এ এলাকা দখল করে এবং স্থায়ীভাবে বসতিতে উৎসাহ পায়। কেপ কলোনিতে বুয়রাও থাকত। বুয়র শব্দটা ডাচ -এর মানে চাষি। তারা কথা বলত আফ্রিকানা ভাষায়- ডাচ ও জার্মানিক ভাষা মিলে আফ্রিকান্স ভাষা টি তৈরি হয়েছিল। পরে তারা কেপ কলোনি থেকে ব্রিটিশদের চাপে চলে যায় ও দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তরাঞ্চলে একটি বুয়র রিপাবলিক গড়ে তোলার চেষ্টা করে। ১৮৬৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার খনিতে হীরে ও ১৮৮৪ সালে স্বর্ণ পাওয়া যায়। এসব মূল্যবান সম্পদের সন্ধানে বহিরাগত বাড়তে থাকে। এর কিছুকাল পরে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসী, ব্রিটিশ শাসকশ্রেনি ও ডাচ-বুয়র দের মধ্যে ত্রিমূখি লড়াই আরম্ভ হয়। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গঠিত হয় (যেমন, সাদাদের "ন্যাশনাল পার্টি", কালোদের আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস

১৯৪৮ সালের নির্বাচনে সাদাদের ন্যাশনাল পার্টি জয়ী হয়। তারপর থেকে শ্বেতকায় শাসকশ্রেনি নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে অশেতাঙ্গদের। এর ফলে যে নীতি নিতে হয়-তাই "আপার্টহাইট" বা বর্ণবৈষম্য নীতি। সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকাকে সাদা, কালো, বর্ণময় বা কালারড ও ইন্ডিয়ান-এই চার ভাগে ভাগ করে ফেলা হল।

প্রতিরোধ

সম্পাদনা

আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অন্যতম নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৬২ সালে তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার গ্রেপ্তার করে ও অন্তর্ঘাত সহ নানা অপরাধের দায়ে যাবৎজীবন কারাদণ্ড দেয়।

দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার সে সময় একটি আইন প্রণয়ন করেছিল, যেটি পাসপত্র আইন নামে পরিচিত। ওই আইনে বলা হয়েছিল, কৃষ্ণাঙ্গদের সব সময় তাদের পরিচয়সংক্রান্ত নথিপত্র বহন করতে হবে। ১৯৬০ সালের ২১ মার্চ রাজধানী জোহানেসবার্গের থেকে ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে শার্পভিল শহরতলির থানার বাইরে বর্ণবৈষম্য আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে জড়ো হন কৃষ্ণাঙ্গরা। এক পর্যায়ে পুলিশ তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। নিহত হন ৬৯ জন ও আহত হন অন্তত ১৮০ জন।[]

১৯৭৬ সালে ভাষার প্রশ্নে কৃষ্ণাঙ্গরা ন্যাশনাল পার্টি নিয়ন্ত্রিত সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আফ্রিকান্স ভাষাকে স্কুলের ভাষা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধান মন্ত্রী পি ডবলিউ বোথা। ডেসমন্ড টুটু দেশের বাইরে থেকে আন্দোলন-সংগ্রামের যোগ। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকীয় পণ্য বয়কট করতে ডাক দেন এবং অবিনিয়োগ আন্দোলন শুরু করেন। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রযুক্তরাজ্য দক্ষিণ আফ্রিকায় বিনিয়োগ বন্ধ রাখে। তার ডাকে কেপ টাইনের রাস্তায় ৩০ হাজার মানুষ নেমে আসে এবং বিশ্বব্যাপী বর্ণবৈষম্য নীতির প্রতি প্রতিবাদ শুরু হয়।

প্রচন্ড প্রতিরোধের মুখে সরকার নেলসন ম্যানডেলাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৯০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি তিনি কারামুক্ত হন। এর পর তিনি তার দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের সাথে শান্তি আলোচনায় অংশ নেন। এর ফলশ্রুতিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটে এবং সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে ১৯৯৪ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।[]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. শার্পভিলে গণহত্যার ৫০তম বার্ষিকী
  2. "দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যাণ্ডেলার মুক্তি"। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ ডিসেম্বর ২০১৮ 

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা