বিষয়বস্তুতে চলুন

মাটি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

এটি এই পাতার বর্তমান সংস্করণ, যা তুষার কান্তি ষন্নিগ্রহী (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৯:০২, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে সম্পাদিত হয়েছিল। উপস্থিত ঠিকানাটি (ইউআরএল) এই সংস্করণের একটি স্থায়ী লিঙ্ক।

(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)
চৈত্রের দিনে বাংলাদেশের ফেটে যাওয়া মাটি
Surface-water-gley developed in glacial till, Northern Ireland

মাটি বা মৃত্তিকা হলো পৃথিবীর উপরিভাগের নরম আবরণ। পাথর গুঁড়ো হয়ে সৃষ্ট খনিজ পদার্থ এবং জৈব যৌগ মিশ্রিত হয়ে মাটি গঠিত হয়। জৈব পদার্থের উপস্থিতিতে ভূমিক্ষয় আবহবিকা, বিচূর্ণিভবন ইত্যাদি প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে পাথর থেকে মাটির উদ্ভব হয়েছে। সে কারণে অতি প্রাচীন কালের মাটি পৃথিবীতে পাওয়া যায় না । ভূ-ত্বক, জলস্তর, বায়ুস্তর এবং জৈবস্তরের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে পাথর থেকে মাটি তৈরি হয়। রাশিয়ান বিজ্ঞানী ডকুশেভকে মৃত্তিকা বিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তিনি মৃত্তিকা সম্পর্কে ধারণা দেন।

বিজ্ঞানী ডকুশেভ ছাড়াও আরো অনেক বিজ্ঞানী মাটিকে বিভিন্ন ভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। তবে তাদের মধ্যে বিজ্ঞানী কীলোগ এর সংজ্ঞা থেকে মাটি সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো ধারণা পাওয়া যায়। শুকনো গুঁড়ো মাটিকে সাধারণভাবে ধুলা বলা হয়। মাটি সৃষ্টির জন্য পাঁচটি প্রভাবক আছে। এগুলো হল:

  1. মৃত্তিকা পদার্থ
  2. জলবায়ু
  3. জৈব উপাদান
  4. ভূসংস্থান
  5. সময়

এই পাঁচটির কোন একটি ছাড়াও মাটি গঠন সম্ভব নয়। মাটিতে খনিজ এবং জৈব পদার্থের মিশ্রণ রয়েছে। এর উপাদানগুলো কঠিন, তরল ও বায়বীয় অবস্থায় মাটিতে বিদ্যমান ।[][] মাটির কণাগুলো আলগাভাবে যুক্ত হওয়ার ফলে এর মধ্যে বাতাস ও জল চলাচলের যথেষ্ট জায়গা রয়েছে।[] এজন্য মাটিকে বিজ্ঞানীরা ত্রি-ধাপ পদার্থ (Three state system) বলে অভিহিত করেন।[] অধিকাংশ এলাকার মাটির ঘনত্ব ১ থেকে ২ গ্রাম/ঘন সে.মি.। [] পৃথিবীর উপরিভাগের অধিকাংশ মাটিই টারশিয়ারি যুগের পরে গঠিত হয়েছে। আর কোনো স্থানেই প্লাইস্টোসিন যুগের পুরানো মাটি নেই।[]

Darkened topsoil and reddish subsoil layers are typical in some regions.

মাটির গুণাগুণ

[সম্পাদনা]

মাটি হলো ভূপৃষ্ঠের উপরিতলের নরম খনিজ এবং জৈব উপাদানের মিশ্রণ যা উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য প্রাকৃতিক মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। মাটি প্রধানত ৪ টি প্রধান উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। এগুলো হলোঃ

  1. খনিজ পদার্থ - ৪৫%;
  2. জৈব পদার্থ - ৫%;
  3. বায়ু - ২৫%;
  4. পানি - ২৫%;

খনিজ পদার্থ

[সম্পাদনা]

ভূ-ত্বক প্রথমে শিলা দ্বারা গঠিত ছিল। পরে তা শিলা ক্ষয় প্রক্রিয়ায় ভেঙ্গে ছোট খণ্ডে বা এককে রূপান্তরিত হয়। মাটির এই অংশ বালি, পলি ও কর্দম কণা দ্বারা গঠিত। শিলা ক্ষয় প্রক্রিয়ার ফলে উপর্যুক্ত কণা ও অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদান যেমন- নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান মাটিতে মুক্ত হয়। মাটিতে খনিজের পরিমাণ হলো ৪৫%।

জৈব পদার্থ

[সম্পাদনা]

মাটিতে ১-২% জৈব পদার্থ থাকে তবে হিম অঞ্চলের মাটি ২-৫% জৈব পদার্থ ধারণ করে। এই সব জৈব পদার্থ উদ্ভিদ ও প্রাণীর অবশিষ্টাংশ ও মলমূত্র হতে মাটিতে আসে। জৈব পদার্থ মাটির আবদ্ধকরণ পদার্থ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ খুব কম হলেও এটি ব্যাপকভাবে মাটির গুণাবলী নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

জৈব পদার্থ নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে-

সমস্ত পুষ্টি উপাদানের গুদাম ঘর হিসেবে কাজ করে,মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈব গুণাবলী উন্নত করে,ভূমি ক্ষয় রোধ করে,পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে,অনুজীবের প্রধান শক্তি হলো এই জৈব পদার্থ এবং মাটিতে নাইট্রোজেনের প্রধান উৎস এ জৈব পদার্থ।

বায়ু ও পানি

[সম্পাদনা]

প্রবল বর্ষার সময় বা সেচ দিলে মাটির অধিকাংশ রন্ধ্রই পানি দ্বারা পূর্ণ হয়। কিন্তু শুকনা বা খরার সময় ঐ রন্ধ্রগুলো বায়ু দ্বারা পূর্ণ হয়। বায়ুমন্ডলের বায়ু অপেক্ষা মাটির বায়ুতে বেশি পরিমাণ কার্বন ডাই-আক্সাইড ও জলীয়বাষ্প থাকে কিন্তু অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকে। বায়ুর প্রধান কাজ হলো শ্বসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা। বায়ু ও পানির গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো-

মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক কার্য নিয়ন্ত্রণ করা; শিলা ক্ষয় প্রক্রিয়ায় সাহায্য করা; সালোকসংশ্লেষণ পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করা এবং দ্রাবক ও পুষ্টি উপাদানের বাহক হিসেবে কাজ করা।

মাটির প্রকারভেদ

[সম্পাদনা]

বালি, পলি ও কাদা- এই তিনটি স্বতন্ত্র মাটি কণার তুলনামূলক অনুপাতের ওপর ভিত্তি করে মাটির বুনটসমূহের নামকরণ করা হয়েছে। বিভিন্ন মাটি বিভিন্ন অনুপাতে বালি, পলি ও কাদা কণা ধারণ করে থাকে। কোন মাটিতে বালি কণার পরিমাণ বেশি, আবার কোনটাতে কাদা কণার পরিমাণ বেশি। এই পরিবর্তনের নির্দিষ্ট সীমারেখায় রেখে মাটিকে ১২ টি গ্রুপ বা দলে বিভক্ত করা হয়। এই দলগুলোই বুনটভিত্তিক শ্রেণী বলে পরিচিত। এই শ্রেণীগুলোর একটির হতে অন্যটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক ধর্মে যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যে মাটিতে অধিক পরিমাণ কাদা কণা থাকে তাকে কাদা মাটি, যে মাটি অধিক পরিমাণ পলি কণা ধারণ করে তাকে পলি মাটি, আর যে মাটিতে বালি কণার পরিমাণ বেশি থাকে তাকে বালি মাটি বলে। যদি কোন মাটি এই তিনটি শ্রেণীর একটিরও প্রভাব বিস্তারকারী ভৌতিক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন না করে (যেমন-৪০% বালি কণা, ২০% কাদা কণা ও ৪০% পলিকণা যুক্ত মাটি) তবে তাকে দোআঁশ মাটি বলে। দোআঁশ মাটিতে বালি, পলি ও কাদা কণার শতকরা পরিমাণ সমান থাকেনা। কিন্তু এ বালি, পলি ও কাদা কণাসমূহের কাছাকাছি প্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম প্রদর্শন করে।

মাটির গুণাগুণ

[সম্পাদনা]

সুষ্ঠুভাবে মাছ চাষ ব্যবস্থাপনায় পুকুর তৈরির জন্য দোআঁশ ও বেলে- দোআঁশ মাটি সবচেয়ে ভাল। এ ধরনের মাটি সহজে পানি ধারণ করে রাখতে পারে। মাটির পিএইচ (PH)-এর মাত্রা ৫.০ এর উপরে থাকা সমীচীন। মাটিতে বিদ্যমান পুষ্টি পদার্থ ও পিএইচ-এর ওপর ভিত্তি করে মাটিকে সাধারণতঃ ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- উচ্চ উৎপাদনশীল, মধ্যম উৎপাদনশীল ও নিম্ন উৎপাদনশীল (সারণি-১)।

সারণি-১: মাটির পুষ্টিমান ও পিএইচ অনুযায়ী পুকুর-জলাশয়ের শ্রেণিবিন্যাস উৎপাদনশীলতার শ্রেণী পিএইচ মাত্রা পুষ্টি উপাদানের মাত্রা (মিগ্রা/কিলো) নাইট্রোজেন ফসফরাস কার্বন উচ্চ ৭.৫-৬.৫ >৫০ ৬-১২ >১.৫ মধ্যম ৬.৫-৫.৫ ২৫-৪৯ ৩-৫ >০.৫-১.৪ নিম্ন <৫.৫ <২৫ <৩ <০.৫

প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা কম হলেও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে লাভজনক মাছ চাষের জন্য পুকুরকে উপযোগি করে তোলা যায়। এক্ষেত্রে খরচ কিছুটা বেশি পড়ে।

মাটির গঠন, বর্ণ, পিএইচ-এর ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের মাটিকে সাধারণভাবে ৬ ভাগে ভাগ করা যায়। এ ভিত্তিতে বাংলাদেশের মাটির শ্রেণিবিন্যাস ও প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা নিচের সারণিতে দেয়া হলো (সারণি-২)।

সারণি-২: অঞ্চলভেদে মাটির গুণাগুণ

ক্র.নং অঞ্চল মাটির প্রকার PH-র ভিত্তিতে মাটির ধরন মাটির বর্ণ উৎপাদনশীলতা ১ বরেন্দ্র, মধুপুর গড়, সাভার, গাজীপুর, সিলেট, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর অংশ বিশেষ এটেল, কাদা ও বালিযুক্ত কাদা বেশি অম্লীয় লাল ও বাদামী প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা কম ২ যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, পাবনা, রাজশাহী, ঢাকা ও বরিশালের কিয়দংশ পলিযুক্ত এটেল ক্ষারীয় হালকা ও বাদামী গাঢ় ধূসর প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা বেশি ৩ ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ঢাকা, রংপুর, বগুড়া, পাবনা ও ফরিদপুরের কিয়দংশ পলিযুক্ত দো-আঁশ নিরপেক্ষ থেকে ক্ষারীয় ধূসর ও গাঢ় ধূসর প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা তুলনামূলক বেশি ৪ রংপুর-দিনাজপুরের কিয়দংশ, মানিকগঞ্জ, গাইবান্ধা, ফরিদপুর ও টাঙ্গাইলের কিয়দংশ বালি ও বালিযুক্ত পলি কিছুটা অম্লীয় ধূসর প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা তুলনামূলক কম ৫ নদী সন্নিকটস্থ অঞ্চল বালিযুক্ত পলি অম্লীয়/ক্ষারীয়/নিরপেক্ষ ধূসর থেকে কালচে ধূসর প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা তুলনামূলক কম ৬ উপকূলীয় অঞ্চলসমূহ পলি ও কাদার ভাগ বেশি অম্লীয় কালো বা ছাই রং প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা কম

মাটির ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণ

[সম্পাদনা]

যে অঞ্চলের মাটি উর্বর সে স্থানে খনন করা পুকুরও সাধারণভাবে উর্বর হয়ে থাকে এবং সে অঞ্চলের পুকুরে মাছের উৎপাদনও ভাল হয়। উর্বর মাটি পানিতে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যের যোগান দেয় এবং পানি দূষণ রোধে ভূমিকা রাখে। সাধারণভাবে মাটি ৪ প্রকারের হয়ে থাকে ক) এটেল মাটি, ২) বেলে মাটি, গ) লাল মাটি এবং ঘ) দোআঁশ মাটি। দোআঁশ মাটির পুকুর মাছ চাষের জন্য সর্বাধিক উপযোগি। বেলে মাটির পানি ধারণক্ষমতা খুবই কম এবং লাল মাটির পুকুরে পানি প্রায় সবসময় ঘোলা থাকে। এজন্য বেলে মাটি ও লাল মাটিতে খনন করা পুকুর মাছ চালের জন্য ততটা উপযোগি হয় না। বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি ধরে রাখা ও আদান প্রদানে দোআঁশ মাটি উত্তম।

   দোআঁশ মাটি মাছ চাষের জন্য উত্তম;
   এটেল মাটি মাছ চাষের জন্য কম উপযোগি;
   বেলে মাটি মাছ চাষের উপযোগি নয়;
   লাল মাটিতে মাছচাষ ব্যয়বহুল।

মাছ চাষের জন্য বদ্ধ জলাশয়ের পানির উপযোগিতা মাটির কয়েকটি উপাদানের মানের ওপর র্নিভর করে। যথা- পি,এইচ, ফসফরাস, নাইট্রোজন, কার্বন-ড্রাই অক্সাইড, জৈব পদার্থ ইত্যাদি। নিচে এসব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ

পিএইচ মাটির পিএইচ (PH) ৬.৫-৮.০ এর মধ্যে হলে তা মাছ চাষের জন্য উত্তম। অনুকূল পিএইচ মাত্রায় ফসফরাসের যোগান বৃদ্ধি পায় এবং অ্যামোনিয়া ও নাইট্রোজেনঘটিত অণুজীব অধিক কর্মক্ষম হয়। পি এইচ ৬.০-এর নিচে হলে মাটি অধিক অম্লীয় হয় এবং পানিতে ক্ষতিকর মৌলিক পদার্থের উপস্থিতি দেখা দেয়। আবার পিএইচ-এর মাত্রা ৯.০ এর বেশি হলে অণুজীবগোষ্ঠী নিস্ক্রিয় হয় ও ফসফরাসের সরবরাহ হ্রাস পায়। এতে উদ্ভিদ প্ল্যাংটনের উৎপাদন খুব কমে যায়।

ফসফরাস ফসফরাস মাটিতে ক্যালসিয়াম, আয়রণ ও এ্যালুমিনিয়ামের ফসফেট হিসেবে অবস্থান করে। মাটিতে পরিমিত জৈব পদার্থের উপস্থিতিই সহজপ্রাপ্য ফসফরাসের সরবরাহ অব্যাহত রাখে। ফসফরাসের প্রাচুর্যতা পুকুরের প্রাথমিক উৎপাদনশীলতা সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে। ফসফরাস সবুজ শেওলার বংশ বৃদ্ধিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ফলে অধিক পরিমাণে উদ্ভিদ-প্ল্যাংঙ্কটন উৎপন্ন হয়। মাছ চাষের জন্য প্রতি ১০০ গ্রাম মাটিতে ১০-১৫ মিলিগ্রাম হারে সহজপ্রাপ্য ফসফেট থাকা উচিত।

নাইট্রোজেন বায়ুমন্ডলের নাইট্রোজেনই মাটির নাইট্রোজেনের প্রধান উৎস। প্রতি ১০০ গ্রাম মাটিতে ৮-১০ মিলিগ্রাম হারে সহজপ্রাপ্য নাইট্রোজেন থাকা দরকার। নাইট্রোজেন উদ্ভিদকে ঘন সবুজ রাখে। পরিমিত নাইট্রোজেন উপস্থিতিতে উদ্ভিদ-প্ল্যাংটনের খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হয় এবং বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। ফলে অধিক পরিমাণে উদ্ভিদ-প্ল্যাঙ্কটন উৎপন্ন হয় ও মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

জৈব পদার্থ মাটিতে বিদ্যমান জৈব পদার্থ যে কোন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় একটি অপরিহার্য উপাদান। জৈব পদার্থ পুকুরের তলায় মাটিকে সজীব ও সক্রিয় রাখে এবং পানি চুয়ানো বন্ধ করে মাটির পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে। জৈব পদার্থ ফরফরাস ও নাইট্রোজেনের প্রধান উৎস। জলজ পরিবেশে জৈব পদার্থ আবহাওয়া থেকে সরাসরি নাইট্রোজেন ধারণ করে।

প্রকারভেদ

[সম্পাদনা]

বিভিন্নভাবে মৃত্তিকাবিজ্ঞানীরা মাটির প্রকারভেদ করেছেন। তার মধ্যে - বেলে, এঁটেল, দো-আঁশ এবং পলিমাটি অন্যতম । বিভিন্ন ধরনের মাটির মধ্যে সম্পর্ক বুঝতে এবং কোনো বিশেষ কাজে মাটির উপযোগিতা যাচাই করার জন্য মাটির বিভিন্ন রকমের শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে । পূর্বে এইরকম একটি ধারণা ছিল যে, মাটি তৈরির উপকরণ এবং কারণগুলি-ই মাটিকে কোনো একটি নির্দিষ্ট বহির্গঠন দান করে । এই ধারণা অনুযায়ী বানানো প্রথম দিককার শ্রেনীবিভাগ গুলির মধ্যে ১৮৮৮ খ্রীস্টাব্দে রাশিয়ান বৈজ্ঞানিক Dokuchaev (দকুচেভ)-এরটি উল্লেখযোগ্য । পরবর্তী কালে অনেক মার্কিন এবং ইউরোপীয় গবেষক এটিকে উন্নত করে ১৯৬০ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ একটি গ্রহণযোগ্য শ্রেণিবিভাগ তৈরী করেন । এই ষাটের দশকে একটি অন্য ধরনের শ্রেণিবিভাগ তৈরী হয়, যেখানে মাটি তৈরির উপকরণ ও কারণের থেকে মাটির বহির্গঠনের উপর বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে । পরবর্তীকালে এটি-ও ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে ।World Reference Base for Soil Resources (WRB)[] নামের সংস্থাটি মাটির আন্তর্জাতিক শ্রেণিবিভাগের কাজে জড়িত।

মাটির উপাদান

[সম্পাদনা]

মাটিতে সাধারণত দুই ধরনের উপাদান থাকে। অজৈব উপাদান এবং জৈব উপাদান।

মাটির অজৈব উপাদান অজৈব উপাদানের মধ্যে আছে- (১) শিলাচূর্ণ-এই শিলাচূর্ণের উৎস আগ্নেয় শিলা, পলল শিলা ও পরিবর্তিত শিলা। শিলাচূর্ণ আবার নানারকম হতে পারে যেমন মোটা, মাঝারি বা অতিসূক্ষ্ম দানাবিশিষ্ট। মোটাদানাকে বালি, মাঝারি দানাকে পলি আর সূক্ষ্ম দানাকে পাঁক বলা হয়। বালিই ক্ষয় হতে হতে পলিতে ও পরে পাঁকে পরিণত হয়।

(২) জল-বিভিন্ন শিলাচূর্ণের ফাঁকগুলিতে জল থাকার জন্য মাটি তার নমনীয় আকার পায়। এই জলের উপস্থিতি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কেন না মাটিতে সজীব জীবাণুর অস্তিত্বের জন্য বা মাটির উপর উদ্ভিদ জন্মানোর জন্যে এটি দায়ী।

(৩) গ্যাস-বায়ুমণ্ডলের গ্যাসও মাটির শিলাচূর্ণের ফাঁকগুলিতে প্রবেশ করে। এই গ্যাস বা বাতাস থাকায় মাটি ঝুরঝুরে হয় ও জীবাণুর জীবনধারণ তথা উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে সহজতর করে।

(৪) খনিজলবণ-এর মধ্যে আছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, গন্ধক, লৌহ প্রভৃতি। এগুলি ক্যালসিয়াম কার্বনেট, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট প্রভৃতি যৌগের আকারে উপস্থিত থাকে। অনেকসময় জলে দ্রবীভূত হওয়া কালে ঐসব খনিজ লবণ ভেঙ্গে অস্থায়ী 'আয়ন' (ion) গঠন করে। জলও ঐভাবে ভেঙ্গে গিয়ে হাইড্রোজেন আয়ন ও হাইড্রক্সিল আয়নে পরিণত হতে পারে।

মাটির জৈব উপাদান

মাটির জৈব উপাদানের মধ্যে আছে (ক) মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণীজ বস্তু ও (খ) সজীব মৃত্তিকাবাসী জীবাণু।

(ক) মৃত উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ বস্তু

পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত যে অগণিত ছোট-বড় প্রাণীর মৃত্যু ঘটছে সেগুলির শবদেহ সবই আশ্রয় নেয় মাটির বুকে। আবার গাছপালার পাতা, ফুল ফল ঝরে পড়ে ঐ মাটিরই উপরে। প্রাণীর মতো উদ্ভিদেরও মৃত্যু ঘটে আর সেগুলি মাটিতে গিয়ে মেশে। এছাড়া প্রাণীর পরিত্যক্ত মল-মূত্রও মাটিতে এসে পড়ে। মাটির মধ্যে বসবাসকারী জীবাণুর (ব্যাকটিরিয়া) আক্রমণে ঐসব জৈব বস্তু ভেঙ্গে বা গলে যেতে থাকে যাকে আমরা পচন বলি। এইভাবে মাটি পচনশীল জৈব বস্তুতে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। পচন চলাকালে ঐ জৈব বস্তু যে কালচে আকার নেয় তাকে হিউমাস (Humus) বলে। মাটির উপরের দিকে স্তরে হিউমাসের পরিমাণ বেশি ও যতো নীচে নামা যায় এর পরিমাণ ততোই কমতে থাকে।

হিউমাস অত্যন্ত মূল্যবান জৈব সারের কাজ করে। এছাড়া এটি মাটির জল ও বাতাস ধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। তাই যে মাটিতে হিউমাসের পরিমাণ যতো বেশী তা ততোই উর্বর।

(খ) সজীব মৃত্তিকাবাসী জীবাণু

মাটির বুকে যে অসংখ্য সূক্ষ্মদেহী জীবাণু ও অন্যান্য জীবের বাস সেগুলি মাটির অন্যতম উপাদানে পরিণত হয়েছে। খানিকটা মাটি হাতে নিলে সাদা চোখে এদের দেখা যাবে না কিন্তু তাতে আছে বিপুল সংখ্যক এইরকম সজীব বস্তু। এগুলির উপস্থিতি বিভিন্নভাবে মাটির প্রকৃতি বা ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করে। এইসব সজীববস্তুর মধ্যে আছে-

(১) ব্যাকটিরিয়া (Bacteria)-মাটিতে বিভিন্নরকমের ব্যাকটিরিয়ার বাস। এগুলি মুখ্যত জৈববস্তুর পচনে অংশগ্রহণ করে। অর্থাৎ জৈববস্তুকে কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন এই চারটি উপাদানে ভেঙ্গে দেয়। মাটির যেসব ব্যাকটিরিয়া নাইট্রোজেন-ঘটিত উপাদান (যেমন অ্যামোনিয়া) থেকে নাইট্রোজেন যৌগের সৃষ্টি করে সেগুলিকে বলা হয় নাইট্রিফাইং ব্যাকটিরিয়া (Nitrifying bacteria) আর যা নাইট্রোজেন যৌগকে বিশ্লিষ্ট করে তাদের বলা হয় ডিনাইট্রিফাইং (Denitrifying)। এছাড়া মাটিতে এমন ব্যাকটিরিয়াও আছে যেগুলি বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন গ্যাসকে অ্যামোনিয়া, ইউরিয়া প্রভৃতি নাইট্রোজেন যৌগে পরিণত করতে পারে। এগুলিকে বলা হয় নাইট্রোজেন স্থিতিকারী ব্যাকটিরিয়া (Nitrogen-fixing bacteria)। এই নাইট্রোজেন উদ্ভিদের দেহগঠনের এক অতি প্রয়োজনীয় উপাদান, তাই মাটিতে নাইট্রোজেন স্থিতিকারী ব্যাকটিরিয়ার উপস্থিতি জীববিদ্যাগত দিক দিয়ে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

(২) ছত্রাক (Fungi)-

বনাঞ্চলের মাটিতে ছত্রাক সূক্ষ্ম জালের আকারে মাটির নিচে বিস্তারলাভ করে। এগুলি ব্যাকটিরিয়ার মতোই জৈববস্তুর পচন ঘটায়। উদ্ভিদদেহের সেল্যুলোজ পদার্থ ও প্রাণীদেহের (পতঙ্গের) কাইটিন পদার্থ ভাঙ্গার কাজ এদের দ্বারাই সম্পন্ন হয়। মাটিতে আবার পাওয়া যায় ঈষ্ট (Yeast) নামে ছত্রাক যা শর্করা প্রবণকে গাজিয়ে অ্যালকোহল উৎপাদন করে।

(৩) শৈবাল (Algae)-

মাটিতে বহুসংখ্যক এককোষী শৈবালের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। মাটির শৈবালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নীল-সবুজ শৈবাল (Blue-green-algae), সবুজ শৈবাল আর ডায়াটম। নীল-সবুজ শৈবাল বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেনকে নাইট্রেট যৌগে পরিণত করায় তাদের নাইট্রোজেন স্থিতিকারী শৈবাল বলে।

(৪) এককোষী প্রাণী (Protozoa)-

মাটির মধ্যে ব্যাকটিরিয়া, শৈবাল ও ছত্রাকের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে বাস করে অগণিত এককোষী প্রাণী। মাটির জলীয় অংশ যেখানে যতো বেশী এইসব এককোষী প্রাণীও সেখানে থাকে ততো বেশী সংখ্যায়। এই এককোষী প্রাণী, ক্ষণপদযুক্ত, ফ্লাজেলামযুক্ত বা সিলিয়াবিশিষ্ট সবরকমই হতে পারে।

মাটির প্রকৃতি ও জীববিজ্ঞানগত তাৎপর্য

[সম্পাদনা]

মাটির প্রকৃতির একটা বড়ো বৈশিষ্ট্য এই যে বায়ু বা জলের মতো তা অপরিবর্তনশীল নয় বরং বলা যায় সতত পরিবর্তনশীলতাই মাটির ধর্ম। শুধুমাত্র জড় উপাদানে গড়া হলে মাটির মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যেত না। অসংখ্য সঞ্জীববস্তু মাটির অন্যতম উপাদানে পরিণত হওয়ার ফলেই এমন ঘটে। ঐসব সজীববস্তু প্রতিনিয়ত মাটিতে জৈব বা অজৈব পদার্থ যোগ করছে বা মাটি থেকে তা অপসারিত করছে।

ভৌত দিক দিয়েও মাটির প্রকৃতি সর্বত্র সমান নয় কেননা কোথাও বালির ভাগ বেশি কাদার ভাগ কম আবার কোথাও বা তার বিপরীত। মাটির জল বা দ্রবীভূত খনিজ লবণের পরিমাণও সর্বত্র এক নয়।

মাটির প্রকৃতির এই তারতম্য জীববিজ্ঞানগত দিক দিয়ে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। হিউমাস সমৃদ্ধ উর্বর মাটিতে যেভাবে গাছপালা জন্মাবে বেলে বা কাঁকুরে মাটিতে তেমন নয়, বা সমুদ্রতীরের লোনা মাটির উদ্ভিদ হবে ভিন্ন প্রকৃতির। কাজেই মাটি পরিবেশ রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। বিশেষ বিশেষ পরিবেশ রচনার মাধ্যমে মাটি বিশেষ বিশেষ উদ্ভিদ ও জীবজন্তুর আশ্রয়স্থল রচনা করে। কোথাও গড়ে ওঠে গভীর বনভূমি, কোথাও বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, কোখাও জলাভূমি, আবার কোথাও বা বালুময় মরুপ্রান্তর। এইসব বিভিন্ন পরিবেশে সম্পূর্ণ ভিন্নধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণীর বাস। এছাড়া মাটির বুকে যে কতো বিভিন্ন কীটপতঙ্গ বা জীবজন্তু বাসা বাঁধে তার আর ইয়ত্তা নেই। এইভাবে মাটির গভীরে চলেছে নিত্যনতুন প্রাণের লীলাখেলা যাকে জাগতিক ইকোসিস্টেমের অংশবিশেষ বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।

মাটির উপকারিতা

[সম্পাদনা]

মাটি আছে বলেই পৃথিবী এমন শস্যশ্যামল। গাছপালা মাটির উপরেই জন্মায় আর সেইসব গাছপালার ফসল, ফলমূল বা পাতা খেয়ে বাঁচে প্রাণীরা। কাজেই মাটির সঙ্গে সমস্ত জীবজগতের রয়েছে নাড়ীর যোগ। মাটিতে জীবের জন্ম আর মৃত্যুর পর সেই মাটির কোলেই তাদের আশ্রয় নিতে হয়। আমাদের অর্থাৎ সভ্য মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় যা কিছু প্রয়োজন তার সমস্তটাই মাটির দান, কেননা খাদ্যসামগ্রী, পোষাকপরিচ্ছদ, প্রসাধনদ্রব্য বা ঔষধপত্র এসবের মূল উপাদান মাটিতে জন্মানো উদ্ভিদ থেকে পাওয়া বা মাটি থেকে তোলা খনিজ লবণ থেকে উৎপন্ন। কাজেই মানুষের অগ্রগতিতে মাটির দান যে অনেকখানি তা সহজেই অনুমান করা যায়। এককথায় মাটি জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। []

মাটি সংরক্ষণ

[সম্পাদনা]

সংজ্ঞা (Definition): যে বিশেষ পদ্ধতিতে মাটির উর্বরতা শক্তি রক্ষা করা এবং ভূমিক্ষয় রোধ করা হয় তাকে মৃত্তিকা-সংরক্ষণ (Conservation of Soil) বলে। নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে মাটি বা মৃত্তিকা-সংরক্ষণ করা হয়:

(১) সার প্রয়োগ: একই মাটিতে বার বার ফসল উৎপন্ন হলে তার উর্বরতা শক্তি কমে যায়। উর্বরতা শক্তি ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন জৈব সার (Organic Manure) ও রাসায়নিক সার (Chemical Fertilisers) প্রয়োগ করা হয়। এর ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি অক্ষুণ্ণ থাকে।

(২) পর্যায়ক্রমিক চাষ:একই জমিতে বছরের পর বছর যদি একই রকম শস্যের চাষ করা হয় তাহলে মাটির উর্বরতা শক্তি কমে যায়। কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ফসলের চাষ করলে, উর্বরতা শক্তি অনেকাংশে ঠিক থাকে। চীনাবাদাম চাষের পর যদি আলু চাষ করা যায় তাহলে উর্বরতা শক্তি অক্ষুণ্ণ থাকে। যেমন, চীনাবাদাম শিম্বগোত্রীয় উদ্ভিদ। এর মূলে বসবাসকারী ব্যাকটিরিয়া (রাইজোবিয়াম) বাতাসের নাইট্রোজেন আবদ্ধ করে নাইট্রেট লবণ উৎপন্ন করে। ফলে মাটিতে নাইট্রোজেন ঠিক পরিমাণে থাকে। তেমনি ধানচাষের পর মটরগাছের চাষ করা বাঞ্ছনীয়। তাহলে মাটির উর্বরতা শক্তি অক্ষুণ্ণ থাকবে।

(৩) বৃক্ষ রোপণ: গাছের শিকড় মাটিকে আঁকড়ে ধরে রাখে। ফলে ব্যাপকভাবে বৃক্ষ রোপণ করে ভূমিক্ষয় নিবারণ করা যায়। এর ফলে বন্যার হাত থেকে ভূমিকে বা মাটিকে রক্ষা করা যায়।

(৪) বাঁধ নির্মাণ: বন্যার জলে যাতে ভূমিক্ষয় না ঘটে সেজন্য ছোট-বড় বাঁধ নির্মাণ করে বন্যার জল আটকে রাখা যায়, এবং তাতে সুফল পাওয়া যায়।

(৫) নালা তৈরি: বনাঞ্চলে বা পাহাড়ী এলাকায় যদি ছোট ছোট নালা তৈরি করা থাকে তাহলে জলের স্রোত ঐসব নালায় আটকে যায়। সেজন্য অতিরিক্ত বৃষ্টির সময় বিস্তীর্ণ এলাকা ক্ষয় হয় না। এভাবেও কিছুটা মৃত্তিকা-সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়।[]

মাটির উর্বরতা শক্তি

[সম্পাদনা]

মাটির স্তর জীবজগতের অস্তিত্বের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মাটির উপরই গাছপালা জন্মায় ও সভ্য মানুষ মাটিতে ফসল ফলিয়েই অন্নবস্ত্রের সংস্থান করে। মাটির উর্বরতা উদ্ভিদ বৃদ্ধির পক্ষে কেমন প্রয়োজনীয় তা বোধহয় নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। অতীতকালে যখন মানুষ সভ্য হয়নি রা কৃষিকাজ শেখেনি তখন গাছপালা যেখানে জন্মাতো, সেখানেই তার ডালপাতা ফল-মূল ঝরে পড়ার সুযোগ পেত কিংবা ঐ ফলমূল ভক্ষণকারী পশু-পাখির মলমূত্র ও শবদেহ স্বাভাবিকভাবে ঐ জমিতে এসে পড়ায় তখন মাটির উর্বরতা আপনা আপনিই থাকত প্রায় স্থিতিশীল। কিন্তু সভ্য মানুষ কাঠের লোভে বড়ো বড়ো গাছপালা কেটে ফেলায় বন্য পশু-পাখির সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে, মলমূত্র নদী সমুদ্রে নিক্ষেপের ব্যবস্থা করায় ঐসব মূল্যবান জৈব পদার্থ মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির কাজে লাগে না, আর জমির ফসল গোলায় ভরার ফলে বা ফসল কাটার সঙ্গে সঙ্গে তার খড়টুকুও জমি থেকে তুলে আনার ফলে জমিতে প্রায় কিছুই ফিরে যায় না। এছাড়া বরাবর একই জমিতে ফসল ফলানো হলেও তার তেজ বা উর্বরা-শক্তি কমতে থাকে। এইভাবে মাটি ক্রমে অনুর্বর বা নিষ্ফলা হয়ে পড়ে। এর হাত থেকে জমিকে রক্ষা করতে গেলে প্রচুর পরিমাণে জৈব সার ও কৃত্রিম সার প্রয়োগের দরকার। এছাড়া পরিমিত জলসেচ, ভূমিক্ষয় নিবারণ ইত্যাদির জন্যেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। মাটিই যে আমাদের খাওয়ায় পরায় - এ কথা মনে রেখে উর্বরাশক্তি রক্ষণের কাজে যত্নবান না হলে ভবিষ্যৎ বংশধরদের কপালে নিঃসন্দেহে দুর্দিন ঘনিয়ে আসবে। [১০]

ময়মনসিংহে খাওয়ার চেরা মাটি

মাটি খাওয়ার প্রচলন

[সম্পাদনা]

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে দেশে বিস্তর পটভূমিতে মাটি খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এই মাটি খাওয়া বিষয়টি শারীরিক অসুস্থতার মুক্তির সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ আরোগ্য ও উপকারের জন্যই প্রচলিত এই মাটি ভক্ষণ। চীন, জিম্বাবুইয়ে আর যুক্তরাষ্ট্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে নমুনা নিয়ে মাটি খাওয়ার একই উপকারী ফলফল পাওয়া গেছে। জানা যায়, রোমানরা মাটি ও ছাগলের রক্ত মিশিয়ে ওষুধের ট্যাবলেট তৈরি করতো। গত শতাব্দীতেও দেখা যায়, জার্মানিরা খুব মিহি কাদার আস্তরণ রুটির উপর মাখনের পরিবর্তে ব্যবহার করে খেতো।

বাংলাদেশে মাটি খাওয়া

[সম্পাদনা]

মানুষ মাটি খায় সভ্য সমাজে এটি খুবই অজানা কথা। মানুষ সত্যি মাটি খায় এবং তা বাজারে পাওয়া যায়। এর নাম চেরা মাটি। ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোন কোন এলাকার দরিদ্র মানুষের মধ্যে এ চেরা মাটি খাওয়া প্রচলন এখনও লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে পোয়াতি মহিলাদের এ মাটির প্রতি বিশেষ আকর্ষণ। বাজার থেকে প্রয়োজনীয় মাছ তরকারির পাশাপাশি ২/৪ টাকার চেরা মাটিও কিনে তারা।

খাওয়ার মাটিতে যা থাকে

[সম্পাদনা]

পরীক্ষায় দেখা গেছে, চীনের নমুনাটিতে রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে লোহা, ক্যালশিয়াম, ভ্যানডিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ আর পটাশিয়াম। দুর্ভিক্ষের সময় শরীরে এসব পদার্থের অভাব ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের নমুনাটিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় আয়োডিন আর লৌহ। যা শিশু ও মহিলাদের বেশি করে দরকার। অনেক খাবারে এগুলো যথেষ্ট থাকে না। জিম্বাবুইয়ের নমুনাটিতে বেশি দেখা যায় কেওলিনাইট। ডায়রিয়া সারানোর জন্য বাণিজ্যিকভাবে যে ক্যাওপেকটেট পাওয়া যায় তার প্রধান উপাদানই হচ্ছে এই কেওলিনাইট।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Voroney, R. P., 2006. The Soil Habitat in Soil Microbiology, Ecology and Biochemistry, Eldor A. Paul ed. ISBN=0125468075
  2. "James A. Danoff-Burg, Columbia University The Terrestrial Influence: Geology and Soils"। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ মার্চ ২০০৯ 
  3. Taylor, S. A., and G. L. Ashcroft. 1972. Physical Edaphology
  4. McCarty, David. 1982. Essentials of Soil Mechanics and Foundations
  5. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৭ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ মার্চ ২০০৯ 
  6. Buol, S. W. (১৯৭৩)। Soil Genesis and Classification (First সংস্করণ)। Ames, IA: Iowa State University Press। আইএসবিএন 0-8138-1460-X  অজানা প্যারামিটার |coauthors= উপেক্ষা করা হয়েছে (|author= ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য).
  7. IUSS Working Group WRB (২০০৭)। "World Reference Base for soil resources - A framework for international classification, correlation and communication" (পিডিএফ)। FAO। 
  8. উচ্চ মাধ্যমিক জীববিজ্ঞান: শৈলেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা, নভেম্বর ১৯৭৬,পৃ: ২২৭,২২৮,২২৯
  9. মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান-তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা,১৯৮৬, পৃঃ ১৫৮,১৫৯
  10. মাধ্যমিক জীবনবিজ্ঞান, তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা, এপ্রিল ১৯৮৬ পৃঃ ১৫৯