দেওবন্দি

উপমহাদেশের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারী একটি দল

দেওবন্দি (পশতু এবং ফার্সি: دیو بندی, উর্দু: دیو بندی‎‎, বাংলা: দেওবন্দি, হিন্দি: देवबन्दी) হল সুন্নি ইসলাম কেন্দ্রিক একটি পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলন।[] এর কেন্দ্র প্রাথমিকভাবে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানবাংলাদেশ। বর্তমানে যুক্তরাজ্যদক্ষিণ আফ্রিকাতেও এর বিস্তার ঘটেছে।[] নামটি ভারতের দেওবন্দ নামক স্থান থেকে এসেছে। এখানে দারুল উলুম দেওবন্দ নামক মাদ্রাসা অবস্থিত। এই আন্দোলন পণ্ডিত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (১৭০৩-১৭৬২) দ্বারা অনুপ্রাণিত।[] ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ব্যর্থ সিপাহী বিদ্রোহের এক দশক পর ১৮৬৬ সালের ৩০ মে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই আন্দোলনের সূচনা হয়।[][]

দেওবন্দী আন্দোলন
ধর্ম
সুন্নি ইসলাম
ধর্মগ্রন্থ
কুরআন, হাদিস এবং সুন্নাহ

সংজ্ঞা

সম্পাদনা

দেওবন্দি পরিচয়ের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তাকি উসমানি বলেন, "এ চিন্তাধারার সাথে সম্পৃক্ত আলেমরা নিজেদের আকিদা-বিশ্বাস ও কাজকর্মে কুরআন মাজিদ ও সুন্নাতে নববী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ওই ভারসাম্যমান ও মধ্যপন্থী ব্যাখ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত, যা চৌদ্দশ বছর যাবত এ উম্মতের মধ্যে প্রজন্ম পরম্পরায় চলে আসছে।"[]

প্রতিষ্ঠাতা

সম্পাদনা
  1. মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবি []
  2. হাজী মুহাম্মদ আবেদ হোসেন
  3. মাওলানা যুলফিকার আলী
  4. ফজলুর রহমান দেওবন্দি
  5. মুহাম্মদ ইয়াকুব নানুতুবি
  6. রফি উদ্দিন উসমানি

উপর্যুক্ত ছয়জনকে আকাবিরে সিত্তাহ (ছয়জন সম্মানিত ব্যক্তি) বলা হয়।[]

বিশ্বাস

সম্পাদনা

ধর্মতত্ত্ব

সম্পাদনা

আকীদা বা ধর্মীয় ধারণাগত দিক থেকে, দেওবন্দিরা ইসলামী ধর্মতত্ত্বের মাতুরীদী পাঠশাস্ত্র অনুসরণ করে। [][][] তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মাতুরীদী পণ্ডিত নাজমুদ্দিন উমর আল-নাসাফির লেখা আকীদা বিষয়ক রচনা সংক্ষিপ্তাকারে পাঠদান করা হয়।[১০]

দেওবন্দিরা তাকলিদ নামক মতাদর্শের দৃঢ় সমর্থক। অন্যভাবে বলতে গেলে, তারা বিশ্বাস করে যে, একজন দেওবন্দিকে অবশ্যই চারটি সুন্নি ফিকহি মাজহাবের যে কোন একটিতে বিশ্বাস করতে হবে এবং তারা সাধারণত একাধিক মাজহাবের মধ্যস্থ উদার সম্পর্কের বিকাশকে নিরুৎসাহিত করে।[১১] তারা নিজেদেরকে হানাফি মাজহাবের অনুসারী বলে ঘোষণা করে।[][১২] দেওবন্দি আন্দোলনের সাথে সম্পর্কযুক্ত মাদ্রাসার ছাত্ররা সাধারণত হানাফি ফিকহের প্রাচীন গ্রন্থগুলো পড়ে থাকে, যেমন নুর আল-ইদাহ, মুখতাসার আল-কুদুরি, শারহ আল-উইকায়াহ, আর কানজ আল-দাকাইক্ব, তাদের মাজহাব অধ্যয়নের পরিনতি ও সমাপ্তি ঘটে হিদায়াহআল-মারঘিয়ানি নামক গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে।[১৩]

তাকলিদের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে, তাদের অন্যতম প্রধান বিরোধী সংস্কারক দল হল আহলে হাদীস, যারা গাইরে মুকাল্লিদ বা লামাজহাবী নামেও পরিচিত, কারণ তারা সরাসরি কুরআন ও হাদীস অনুসরণের ফলে তাকলিদকে পরিহার করে।[১৪] তারা প্রায়শই তাদেরকে দোষারোপ করে যারা অন্ধ অনুকরণের ফিকহ বা আলেমের নীতির অনুসরণ করে, এবং ঘনঘন প্রত্যেক আলাপ আলোচনা ও আইনগত সিদ্ধান্তে ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি দাবি করে।[১৫] আন্দোলনের প্রায় শুরু থেকেই, দেওবন্দি আলেমরা সাধারণভাবে নিজেদের মাজহাব বিষয়ক অবস্থানকে নিরাপদ রাখার প্রয়াসে বিপুল পরিমাণে ইলমি উপাদান তৈরি করছে। আরও সুস্পষ্টভাবে বলা হলে, দেওবন্দিগণ তাদের এই দাবির সপক্ষে যথেষ্ট পরিমাণ রচনার অবতারণা করেছে যে, হানাফি মাজহাবে কুরআন ও হাদিসের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ।[১৬]

মূল ধর্মগ্রন্থ কুরআন ও হাদিসের আলোকে তাদের মাজহাবকে প্রমাণ করার জন্য, দেওবন্দিগণ তাদের মাদ্রাসাগুলোতে হাদিস অধ্যয়নের প্রতি অভূতপূর্ব গুরুত্ব প্রদানের জন্য বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। তাদের মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম ইসলামি পাণ্ডিত্যের বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে একটি অনন্য বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটিয়েছে, তা হল দাওরায়ে হাদিস, একজন ছাত্রের উন্নত মাদ্রাসা প্রশিক্ষণের একটি পৃথক বর্ষ, যাতে সুন্নি হাদিসের সকল সংকলন (সিহাহ সিত্তাহ) পর্যালোচিত হয়।[১৭] দেওবন্দি মাদ্রাসাগুলোতে, শায়খুল হাদিসের অথবা সহিহ বুখারির অধিষ্ঠিত অধ্যাপকের পদবিকে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে গণ্য করা হয়।

সুফিবাদ ও ওয়াহাবিবাদ

সম্পাদনা

বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ে অবস্থান

সম্পাদনা

ইতিহাস

সম্পাদনা

দক্ষিণ আফ্রিকা

সম্পাদনা

পরিচয়

সম্পাদনা

দারুল উলুম দেওবন্দের শতবার্ষিকী সম্মেলনে আবুল হাসান আলী হাসানী নদভী দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়াতের পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "এই প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এটি তার দৃষ্টিকে বিরোধপূর্ণ বিষয়াদির পরিবর্তে তাওহীদ ও সুন্নাতের ওপর নিবদ্ধ রেখেছে। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো সুন্নতের অনুসরণের স্পৃহা ও ভাবনা। তৃতীয় বৈশিষ্ট্য আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের ভাবনা, সব সময় আল্লাহকে স্মরণে রাখা এবং ঈমান ও নিজের আমলের হিসাবের জযবা। চতুর্থ উপাদানটি হলো আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত করার চেতনা প্রচেষ্টা ও দ্বীনি মর্যাদাবোধ। এই চার উপাদানের সমন্বয়ে একজন মানুষ দেওবন্দী হয়। কারও মাঝে যদি এর একটি উপাদান কম পাওয়া যায়, তা হলে তাও দেওবন্দিয়াত অসম্পূর্ণ। এটিই হলো দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতীক।"[১৮]

গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব

সম্পাদনা

সম্মেলন

সম্পাদনা

দেওবন্দিদের অধীনে বাংলাদেশে দুইটি বড় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বিশ্ব ইজতেমা নামে দাওয়াতে তাবলীগ জামাতের একটি ইসলামি মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মধ্যেপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ এ সম্মেলনে যোগদান করে। আরেকটি মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় বরিশালের চরমোনাই ইউনিয়নে।

আরও দেখুন

সম্পাদনা

আরও পড়ুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "INDIA"। Darul Uloom Deoband। সংগ্রহের তারিখ ২৯ এপ্রিল ২০১৩ 
  2. Tayob, Abdulkader; Niehaus, Inga; Weisse, Wolfram। Muslim Schools and Education in Europe and South Africa (ইংরেজি ভাষায়)। Waxmann Verlag। পৃষ্ঠা ৮৭। আইএসবিএন 978-3-8309-7554-0 
  3. Asthana, N. C.; Nirmal, Anjali (২০০৯)। Urban Terrorism: Myths and Realities (ইংরেজি ভাষায়)। Pointer Publishers। পৃষ্ঠা ৬৬। আইএসবিএন 978-81-7132-598-6 
  4. "Deobandis - Oxford Islamic Studies Online"www.oxfordislamicstudies.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-০৬ 
  5. ‌দেওবন্দ আন্দোলনঃ ইতিহাস,ঐতিহ্য ও অবদান;আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া;২০১১;পৃ.১৫৭
  6. উসমানি, মুহাম্মদ তাকি (২০২১)। আমার জীবনকথা। মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, আবুল বাশার কর্তৃক অনূদিত। বাংলাবাজার, ঢাকা: মাকতাবাতুল আশরাফ। পৃষ্ঠা ৩৯। আইএসবিএন 9789849173038। ২২ নভেম্বর ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ নভেম্বর ২০২২ 
  7. Spevack, Aaron (২০১৪)। The Archetypal Sunni Scholar: Law, Theology, and Mysticism in the Synthesis of Al-Bajuri। State University of New York Press। পৃষ্ঠা 49। আইএসবিএন 978-1-4384-5370-5 
  8. David Emmanuel Singh, Islamization in Modern South Asia: Deobandi Reform and the Gujjar Response, p 167.
  9. ibnummabd on February 19, 2009 at 6:04 pm (১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৯)। "About"। Deoband.org। ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ এপ্রিল ২০১৩ 
  10. Martin van Bruinessen, Stefano Allievi, Producing Islamic Knowledge: Transmission and Dissemination in Western Europe, p 100. আইএসবিএন ১১৩৬৯৩২৮৬০
  11. Martin Van Bruinessen, Julia Day Howell, Sufism and the 'Modern' in Islam, p 130, আইএসবিএন ১৮৫০৪৩৮৫৪৪
  12. Metcalf, Barabara. "Traditionalist" Islamic Activism: Deoband, Tablighis, and Talibs ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে. "These orientations --"Deobandi," "Barelvi" or "Ahl-i Hadith" -- would come to define sectarian divisions among Sunni Muslims of South Asian background to the present."
  13. Haque, Ziaul (১৯৭৫)। "Muslim Religious Education in Indo-Pakistan"। Islamic Studies। Islamic Research Institute, International Islamic University, Islamabad। 14 (4): 284। The following books and subjects are studied ... Fiqh: Hidayah, Quduri, Nur al-Idah, Sharh-i Waqayah, Kanz al-Daqa'iq 
  14. Metcalf, Barbara Daly (২০০২)। Islamic revival in British India : Deoband, 1860-1900 (3rd impression. সংস্করণ)। New Delhi: Oxford Univ. Press। পৃষ্ঠা 141। আইএসবিএন 0-19-566049-8 
  15. Khan, Fareeha (২০০৮)। Traditionalist Approaches to Shari'ah Reform: Mawlana Ashraf 'Ali Thanawi's Fatwa on Women's Right to Divorce (গবেষণাপত্র)। University of Michigan। পৃষ্ঠা 59। Polemicists from among the Ahl-i Hadith were especially being targeted in Thanawi's explanation, since they accused those who adhered to the rulings of one scholar or legal school of "blind imitation." It was the practice of the Ahl-i Hadith to demand and provide proofs for every argument and legal ruling. 
  16. Zaman, Muhammad Qasim (২০০২)। The Ulama in Contemporary Islam: Custodians of Change। Princeton University Press। পৃষ্ঠা 24The Deobandi sensitivity to the Ahl-i Hadith challenge is indicated by the polemics they engaged in with the Ahl-i Hadith and by the large commentaries on classical works of hadith written specifically to refute them 
  17. Zaman, Muhammad Qasim (২০০২)। The Ulama in Contemporary Islam: Custodians of Change। Princeton University Press। পৃষ্ঠা 39...gave a new and, in the Indian context, unprecedented salience to the study of hadith in their madrasas. Hadith had, of course, been studied in precolonial Indian madrasas, but the Deobandis instituted the practice of studying (or, more exactly, “reviewing”) all six of the Sunni canonical collections of hadith in the course of a single year; this practice has come to serve in Indian and Pakistani madrasas as the capstone of a student’s advanced madrasa 
  18. নদভী, আবুল হাসান আলী (২০১৫)। কারওয়ানে যিন্দেগী। বাংলাবাজার, ঢাকা: মুহাম্মদ ব্রাদার্স। পৃষ্ঠা ২৮৮। আইএসবিএন 978-984-91840-1-0 

গ্রন্থপঞ্জি

সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা